স্বাস্থ্য খাতকে বদলে দিতে কোভিড-১৯ এর ৪ অবদান
মহামারির ধাক্কায় বিধ্বস্ত গোটা বিশ্ব। হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন প্রতিদিন। সারা বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অগ্নিপরীক্ষা নিচ্ছে করোনাভাইরাস। তবে মহামারির নিধনযজ্ঞ থামাতে এগিয়ে এসেছেন ডাক্তার, গবেষকসহ বিশেষজ্ঞরা। করোনার বিস্তার রোধ এবং পরবর্তী প্রাণঘাতী জীবাণুকে ঠেকাবার জন্য নেয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু উদ্যোগ নিয়ে এই লেখা।
১. মাস্ক আসলেই কাজ করে
মহামারির শুরুর দিকে মাস্ক করোনার সংক্রমণ রোধ করতে পারে কি না এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক উঠেছিল। এই বিভ্রান্তির পেছনে যৌক্তিক কারণ ছিল। ২০২০-এর মার্চে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুরোধ করে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত বা এতে আক্রান্ত কারও সেবা করতে না হলে কেউ যেন মাস্ক না পরেন।
অসংখ্য স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডব্লিউএইচও-র পরামর্শে সমর্থন দিয়েছিল। এখন অবশ্য অনেকের দাবি, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য মাস্ক বাঁচাতেই এ পরামর্শ দেয়া হয়েছিল।
কিন্তু বেশ কয়েকটি নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, মাস্ক ভাইরাসের বিস্তারের গতি কমিয়ে দিয়েছিল। ইউনিভার্সিটি অফ পিটসবার্গ পাবলিক হেলথ ডাইনামিকস ল্যাবরেটরি-র পরিচালক মার্ক রবার্টস জানান, মাস্ক কার্যকর নয়, এমন দাবি বিজ্ঞানসম্মত নয়।
এটা সত্য যে, মাস্কের স্তর ভেদ করে ভাইরাস একা ঢুকে যেতে পারে। কিন্তু কোভিড-১৯ ও ফ্লুসহ বেশিরভাগ ভাইরাসই বাতাসে একা ভেসে থাকতে পারে না। এসব ভাইরাস শ্বাসপ্রশ্বাস ও হাঁচি-কাশির সঙ্গে নিঃসৃত অর্ধ-তরল পদার্থের (ড্রপলেট) সঙ্গে মিশে বাতাসে ভেসে বেড়ায়। এসব বড় ড্রপলেটকে মাস্ক আটকে দিতে পারে।
রবার্ট বলেন, মাস্ক ব্যবহারে ভাইরাসের বিস্তার অনেক কমে যায়।
গত বছরের এক গবেষণায় দেখা গেছে, কেউ যদি এন৯৫ মাস্ক পরেন, তাহলে তার কাশির ৯৯ শতাংশ ড্রপলেটই আশপাশে ছড়িয়ে পড়া থেকে আটকানো যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ১৫টি রাজ্যে মাস্ক বাধ্যতামূলক করার পর সেসব রাজ্যে ভাইরাসের বিস্তার ২ শতাংশ কমে যায়।
মাস্ক যে কোভিড-১৯-ই প্রতিরোধ করে তা নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২০-২১ মৌসুমে ফ্লু-র বিস্তার আগের বছরের চেয়ে ৯০ শতাংশ কমে গেছে। এর বড় কারণ মানুষ মাস্ক পড়ার কারণে আশপাশে হাঁচি-কাশির ড্রপলেট ছড়িয়ে বেড়ায়নি।
২. টিকা উৎপাদনের গতি
২০২০-এর শুরুর দিকে বিজ্ঞানীরা কোভিড-১৯ এর টিকা উদ্ভাবনের জন্য রাত-দিন কাজ করছিলেন। কয়েক মাসের মধ্যে রেকর্ড গতিতে প্রস্তুত হয়ে যায় টিকা। অথচ কোভিডের আগে একটি টিকা বানাতে লেগে যেত প্রায় এক দশক।
ভবিষ্যতেও যে এমন দ্রুত গতিতে টিকা আবিষ্কার করা যাবে, সেই আত্মবিশ্বাস এখান থেকে জোগাড় হয়ে গেল। স্বাস্থ্যখাতের অবকাঠামো তৈরিই ছিল। তাই টিকা উৎপাদকরা নিজেদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে পেরেছেন।
ফাইজার ও মডার্নার এমআরএনএ প্রযুক্তিতে তৈরি টিকা অবদান রাখে দ্রুত গতিতে টিকা বানাতে। এমআরএনএ টিকা শরীরের কোষকে ভাইরাসের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে আদেশ দেয়।
এরকম দ্রুত গতিতে টিকা উৎপাদনের কারণে মহামারির বিস্তার অনেকটাই কমে যায়।
৩. বর্ণবাদ সমাধানের উদ্যোগ
করোনা মহামারি আরেকটি বাস্তবতা সামনে নিয়ে এসেছে—আমেরিকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কাঠামোবদ্ধ বর্ণবাদ। আমেরিকার একেক বর্ণের ওপর কোভিড-১৯ এর আঘাতের মাত্রা একেক রকম।
২০২০-এর এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, লুইজিয়ানার একটি অঞ্চলে করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রতি ৪ জন রোগীর ৩ জনই ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ। যদিও ওই অঞ্চলের প্রতি ৩ জন অধিবাসীর ১ জন ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ।
কৃষ্ণাঙ্গ, ল্যাটিন ও এশিয়ানদের মধ্যে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হারও শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে ২ থেকে ৪ গুণ বেশি ছিল।
সুজান মুর নামে কোভিড আক্রান্ত এক কৃষ্ণাঙ্গ ডাক্তার এক ভিডিওতে জানান, তীব্র শ্বাসকষ্টের পরও হাসপাতালের ডাক্তাররা তার সমস্যাকে গুরুত্ব দিচ্ছিলেন না। মুর বলেন, 'এভাবে কালোদের মেরে ফেলা হচ্ছে।' মুর পরে কোভিড জটিলতায় মারা যান। এ ধরনের বৈষম্যের ঘটনা সারা আমেরিকাতেই ঘটেছে।
কৃষ্ণাঙ্গরা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন সবচেয়ে খারাপভাবে। কারণ তাদের বেশিরভাগেরই বাস ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়।
নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক টনিয়া পটিয়াট বলেছেন, বেশিরভাগ স্বাস্থ্যকর্মীই সচেতনভাবে বর্ণবাদী নন। তারা বর্ণবাদী আচরণ করেছেন অবচেতনভাবে।
এ ধরনের বৈষম্য লাঘব করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। জাতীয় পর্যায়ে 'অ্যান্টি রেসিজম ইন পাবলিক হেলথ অ্যাক্ট' প্রয়োগ করা হয়েছে। স্বাস্থ্যের ওপর বর্ণবাদের প্রভাব নিয়ে গবেষণা চালানো হবে।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বর্ণবাদ দূর করার জন্য আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে এই সমস্যা দূর করার জন্য কোভিড-১৯ স্বাস্থ্য সংস্থাকে সঠিক পথে টেনে এনেছে।
৪. ঘরে বসে ওষুধ
কোভিড-১৯ এ চলাচল সীমিত হয়ে যাওয়ার কারণে গত বছর ডাক্তাররা ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে রোগী দেখতে শুরু করেন। কোনো পরীক্ষার দরকার পড়লেই কেবল রোগীদের ঘরের বাইরে পাঠানো হতো টেস্টের জন্য। প্রতিষ্ঠিত অনেক ডাক্তার জুম ব্যবহার করে ডিজিটাল স্টেথোস্কোপের মতো রিমোট এক্সাম টুল দিয়েও পরীক্ষা করেন।
প্রয়োজনের তাগিদেই বেশ কিছু টেলিমেডিসিনের উদ্যোগ শুরু হয়। স্বল্পমেয়াদী হিসেবে শুরু হওয়া এই উদ্যোগ দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিত্র বদলে দেয়। 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম'-এর মতো শুরু হয় 'মেডিকেল ফ্রম হোম'। মহামারির পরও এ ব্যবস্থা সম্ভবত চালু থাকবে।
ভার্চুয়াল ভিজিটের ব্যবস্থা ডাক্তার-রোগী উভয়পক্ষেরই বেশ পছন্দ হয়েছে। কোভিড-১৯ এর তীব্রতা কমার পরও এ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। মহামারি থাকুক বা না থাকুক, ভার্চুয়াল ডাক্তার দেখানোই সবার জন্য বেশি নিরাপদ।
সূত্র: ডিসকভার ম্যাগাজিন