নেত্রকোনায় ৬ তরুণের অক্সিজেন সেবায় প্রাণ ফিরে পাচ্ছেন অনেকে
রাত একটার দিকে হঠাৎ শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার প্রত্যন্ত নারায়ণ ডহর গ্রামের বাসিন্দা আরিফুল ইসলামের। কয়েকদিন ধরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তিনি। গভীর রাতে স্বজনরা কোনো উপায় না দেখে ফোন দেন 'সংযোগ কানেক্টিং পিপলস' নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হেল্পলাইনে। অপর প্রান্ত থেকে মেডিকেল টিমের এক সদস্য তাকে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা-পরামর্শ দেন। পাশাপাশি ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই দুই তরুণকে দিয়ে মোটরসাইকেলে পাঠিয়ে দেন একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার। আর এতে যেন প্রাণ ফিরে পান আরিফুল ইসলাম। টানা কয়েকঘণ্টা অক্সিজেন দেয়ার পর ঝুঁকিমুক্ত হন তিনি।
শুধু আরিফুল ইসলামই নন, নেত্রকোনার ছয় স্বেচ্ছাসেবী তরুণ বেশ কিছুদিন ধরে নিরবে-নিভৃতে এমন জরুরী সেবা দিয়ে যাচ্ছেন আরও অনেক কোভিড রোগীকে। বিপদের মুহূর্তে যেন ত্রাণকর্তা হয়ে হাজির হচ্ছেন তারা।
উদ্যমী এই তরুণরা হলেন: মাকসুদুল হাসান জনি, শেখ অলি আহমেদ রনি, আজহারুল ইসলাম, মীর মেহেদী হাসান পরাগ, মোঃ খায়রুল ইসলাম ও ফয়সাল আহমেদ জিসান।
এই স্বেচ্ছাসেবীদের কেউ অনার্স-মাস্টার্সের ছাত্র। আবার কেউ ছোটখাটো চাকরি করেন। পাশাপাশি পরিচালনা করেন 'রক্তদানে নেত্রকোনা' নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। 'রক্তদানে নেত্রকোনা'র সদস্য হিসেবেই 'সংযোগ কানেক্টিং পিপলস্' নামক অপর একটি দাতা সংগঠনের সহায়তায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের অক্সিজেন সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তারা।
মাকসুদুল হাসান জনি জানান, তারা এ পর্যন্ত ২৪ জন করোনায় আক্রান্ত রোগীকে হোম সার্ভিস দিয়েছেন। এর মধ্যে ৮ জনের বাড়ি জেলা সদরের বাইরের উপজেলায়। জনি আরও জানান, 'সংযোগ কানেক্টিং পিপলস'-এর একটি মেডিকেল টিম রয়েছে। তারা কয়েকটি হেল্পলাইনের (মোবাইল নাম্বার) মাধ্যমে চিকিৎসা পরামর্শ দেন।"
"কোভিডে আক্রান্ত রোগীদের দরকার হলে যে কোনও সময় তারা ওই নম্বরগুলোতে ফোন করে চিকিৎসা-পরামর্শ নিতে পারেন। শ্বাসকষ্টের উপসর্গের কথা বললে টিমের সদস্যরা প্রয়োজন বিবেচনা করে আমাদের নির্দেশ দেন এবং অক্সিজেনের ডোজ বলে দেন। সঙ্গে সঙ্গে আমরা মোটরসাইকেলে রোগীর বাড়িতে গিয়ে অক্সিজেন সেবা পৌঁছে দিই," বলেন তিনি।
একই টিমের সদস্য আজহারুল ইসলাম জানান, 'সংযোগ কানেক্টিং পিপলস' এর পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত ১০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার দেয়া হয়েছে। তবে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় চাহিদার তুলনায় এ সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। তাই সরকারি হাসপাতালের সব সিলিন্ডার নিয়মিত রিফিল করে রাখার অনুরোধ জানিয়ে তারা বলেন, "পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে এ ধরনের স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে আরও মানুষের অংশগ্রহণ দরকার।"
ওই তরুণরা আরও জানান, অক্সিজেন সিলিন্ডার রিফিল করতে কিছু খরচ পড়ে। তাই স্বচ্ছল রোগীদের কাছ থেকে কিছু সেবামূল্য নেন তারা।
তবে রোগীর পরিবার দরিদ্র হলে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সেবা দেওয়া। নিজেরা নেন না কোন পারিশ্রমিক। এদিকে নিজেদের সুরক্ষার ব্যাপারেও সবধরনের সতর্কতা অবলম্বন করে চলেন তারা। রোগীর কাছে যাওয়ার আগে পরে নেন পিপিই, ফেইস সিল্ড ও মাস্ক।
জেলা সদরের নিখিলনাথ সড়কের বাসিন্দা সোহরাব উদ্দিন আকন্দ বলেন, "সপ্তাহখানেক আগে গভীর রাতে আমাদের মহল্লায় দীপ নামে একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের মারাত্মক শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। যানবাহনের অভাবে তাকে হাসপাতালে নেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। স্বজনরা তাকে নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তখন 'রক্তদানে নেত্রকোনা' নামক সংগঠনটির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা প্রায় তিন কিলোমিটার হেঁটে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে আসে। তাদের অক্সিজেন সেবায় ছেলেটি সুস্থ হয়।"
জানা গেছে, 'সংযোগ কানেক্টিং পিপলস্' নামের দাতা সংগঠনটি দেশের ৩৪ জেলায় স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে এ ধরনের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। 'রক্তদানে নেত্রকোনা' নামে তরুণদের সংগঠনটি অনেক আগে থেকেই বিনামূল্যে রক্তদানসহ নানাধরনের সেবামূলক কাজ করে আসছে। করোনা পরিস্থিতির এই দুঃসময়ে সংগঠন দুটির উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন স্থানীয় অনেকে। তাদের প্রশাসনিক সহযোগিতা প্রদানেরও দাবি জানিয়েছেন তারা।