অর্থের বিনিময়ে নাগরিকত্ব: ভানুয়াতুর পাসপোর্ট কিনছেন রাজনীতিবিদ, পলাতক আসামি ও দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীরা
প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র ভানুয়াতু। ছোট এই দেশটি 'গোল্ডেন পাসপোর্ট' নামের এক বিতর্কিত স্কিমের আওতায় বিদেশিদের কাছে নাগরিকত্ব বিক্রি করে। এ স্কিমের আওতায় ভানুয়াতু ২০২০ সালে দুই হাজারেরও বেশি মানুষের কাছে পাসপোর্ট বিক্রি করেছে। দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সারা বিশ্বে পুলিশের 'ওয়ান্টেড' তালিকায় থাকা ব্যক্তিও আছে দেশটির নাগরিকত্ব কেনা মানুষদের তালিকায়।
ভানুয়াতুর নাগরিকত্বের সুবিধা হলো, দেশটির পাসপোর্টধারীরা যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ভিসা-ফ্রি ভ্রমণের সুবিধা পেয়ে থাকেন।
অর্থের বিনিময়ে দেশটির নাগরিকত্ব নিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা পাওয়া এক সিরীয় ব্যবসায়ী। এছাড়াও, এ তালিকায় আছেন এক উত্তর কোরীয় রাজনীতিবিদ, দুর্নীতিবাজ ইতালিয়ান ব্যবসায়ী, অস্ট্রেলিয়ার কুখ্যাত মোটরসাইকেল গ্যাংয়ের সাবেক সদস্য এবং ৩৬০ কোটি ডলার ক্রিপ্টোকারেন্সি চুরির দায়ে অভিযুক্ত দুই দক্ষিণ আফ্রিকান ভাই। দ্য গার্ডিয়ান-এর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
মাত্র এক লাখ ৩০ হাজার ডলারের বিনিময়ে ভানুয়াতুর নাগরিকত্ব কেনা যায়। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সময় লাগে এক মাস। দেশটিতে জীবনে কখনও না গেলেও নাগরিকত্ব পেতে কোনো অসুবিধা হয় না।
ভানুয়াতুর পাসপোর্টধারীরা যুক্তরাজ্য ও ইইউসহ ১৩০টি দেশে ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকার পান। দেশটিকে করস্বর্গও বলা হয়। কারণ এখানে আয়কর, কর্পোরেট কর অথবা সম্পদের উপর কোনো কর নেই। এর ফলে দেশটি অর্থপাচারের জন্য আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন, ভানুয়াতুর এই পাসপোর্ট স্কিমের সুযোগ নিয়ে অপরাধীচক্র প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপটিতে ঘাঁটি গেড়ে বসতে পারে।
পরিচয়প্রাপ্তির নতুন দরজা:
গত বছর নাগরিকত্ব বিক্রি করে প্রায় ১২ কোটি ডলার আয় করেছে ভানুয়াতু। ২০২০ সালে দেশটি দুই হাজার ২০০ জনের কাছে নাগরিকত্ব বিক্রি করেছে। পাসপোর্ট কেনা মানুষদের অর্ধেকের বেশি (প্রায় ১২০০) চীনের নাগরিক। এরপর সবচেয়ে বেশি নাগরিকত্ব কিনেছেন নাইজেরিয়ান, রাশিয়ান, লেবানিজ, ইরানী, লিবিয়ান, সিরীয় ও আফগানরা। যুক্তরাষ্ট্রের ২০ জন অস্ট্রেলিয়ার ৬ জন এবং ইউরোপের বেশ কয়েকজন ব্যক্তিও নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন।
বিনিয়োগের মাধ্যমে নাগরিকত্ব দেওয়ার (সিবিআই) স্কিম অবৈধ নয়। পৃথিবীর অনেক দেশেই সিবিআই কর্মসূচির আওতায় নাগরিকত্ব বিক্রি করে। করবিহীন ব্যাংকিং সুবিধাসহ চলাফেরার স্বাধীনতার মতো অনেক যৌক্তিক কারণেই অনেকে এভাবে বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব কিনে থাকেন।
তবে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ভানুয়াতুতে যেভাবে নাগরিকত্ব বিক্রি করা হচ্ছে, তার সুযোগ নিয়ে অপরাধীচক্র প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শক্ত ঘাঁটি গড়ে তুলতে পারে। শতাধিক দেশে ভিসামুক্ত ভ্রমণের সুবিধা নিয়ে মাদক চোরাচালানও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।
গার্ডিয়ানের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, ভানুয়াতুর পাসপোর্ট নিয়ে অনেকেই নিজ দেশ ছেড়ে বাইরে অবৈধ ব্যবসা করছেন।
এছাড়াও, আরেকটি সম্ভাব্য বিপদ হলো, ভানুয়াতুর নাগরিকত্ব নিয়ে যে-কেউ নিজের নাম বদলে ফেলতে পারেন। এর ফলে তারা পেয়ে যান সম্পূর্ণ নতুন পরিচয়। এভাবে অনেক অপরাধী পরিচয় লুকিয়ে গা ঢাকা দেওয়ার সুযোগ পেয়ে যাবে। যার ফলে, ভানুয়াতুর নাগরিকত্ব ও নতুন পরিচয় নিয়ে যেসব দেশে প্রবেশ নিষেধ, সে সব জায়গায় অবাধে যাতায়াত করতে পারবে তারা।
অবশ্য ভানুয়াতু সিটিজেনশিপ অফিস অ্যান্ড কমিশনের চেয়ারম্যান রোনাল্ডো ওয়ার্সালের দাবি, অপরাধের ইতিহাস আছে এমন কাউকে ভানুয়াতুর নাগরিকত্ব দেওয়া হয় না। তিনি আরও দাবি করেন যে, ভানুয়াতুতে আইনিভাবে কেউ নাম বদলাতে চাইলে, তার ব্যাপারে সব ধরনের খোঁজখবর নেওয়া হয়।
ইইউ-এর উদ্বেগ:
ইউরোপিয় ইউনিয়নের (ইইউ) চাপের মুখে ভানুয়াতু প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা প্রত্যেক প্রার্থীর ব্যাপারে সবকিছু খতিয়ে দেখা হবে।
এই প্রতিশ্রুতির পরও দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত এবং নিষেধাজ্ঞা পাওয়া কিংবা নিজ দেশের পুলিশ খুঁজছে, এমন ব্যক্তিদের পাসপোর্ট দিয়েছে দেশটি।
অবশ্য কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত নন, এমন অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিও দেশটির নাগরিকত্ব কিনেছেন। এক আমিরাতি রাজকন্যা ও নাইজেরিয়ান টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব আছেন এই তালিকায়।
এছাড়াও, লিবিয়ার সাবেক জাতিসংঘ সমর্থিত প্রধানমন্ত্রী ফায়েজ আল-সারাজও ভানুয়াতুর পাসপোর্ট কিনেছেন। এ বছরের মার্চে পদত্যাগ করার পর তিনি লিবিয়া ছাড়েন। এরপর ভানুয়াতুর নাগরিকত্ব কেনেন। গার্ডিয়ান অবশ্য তার নাগরিকত্ব কেনার প্রক্রিয়ায় কোনো অসামঞ্জস্য বা অনিয়মের প্রমাণ পায়নি।
ভানুয়াতুর নাগরিকত্ব কেনা রাজনীতিবিদদের তালিকায় আরও আছেন দামেস্কের সাবেক গভর্নর আলা ইব্রাহিম এবং সাবেক ভারতীয় রাজনীতিবিদ বিনয় মিশ্র। বিনয় এখন ভানুয়াতুতে আছেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আছে।
ভানুয়াতুর পাসপোর্ট পাওয়া অন্যান্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন:
- ক্রিপ্টোকারেন্সি বিনিয়োগ প্ল্যাটফর্ম আফ্রিক্রিপ্ট-এর প্রতিষ্ঠাতা রইস ও আমির কাজি। তাদের বিরুদ্ধে ৩.৬ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের বিটকয়েন নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। যদিও দুজনেই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
- ইতালিয়ান ব্যবসায়ী গিয়ানলুইগি টোর্জি। লন্ডনে সম্পত্তি কেনার সময় ভ্যাটিকান কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রায় ১৮ মিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে।
-
তুরস্কের ব্যাংকিং মোগল হাইয়্যাম গারিপোগলু। তার বিরুদ্ধে কয়েক মিলিয়ন ডলার আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।
-
আলজেরিয়ার বিতর্কিত সাবেক সেনা কর্মকর্তা ঘালি বেলকেসির। তার বিরুদ্ধে চারটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।
-
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা ও ব্যবসায়ী খালেদ আল-আহমদ। ২০১৯ সালের জুনে তিনি ভানুয়াতুর নাগরিকত্ব কেনেন।
-
এছাড়াও একজন উচ্চপদস্থ উত্তর কোরীয় রাজনীতিবিদ ও তার স্ত্রী চীনের পাসপোর্ট ব্যবহার করে ভানুয়াতুর নাগরিকত্ব নিয়েছেন বলে ধারণা গার্ডিয়ানের।
কাগজে-কলমে নিয়ম হচ্ছে, সিরিয়া, ইরাক, ইরান ইয়েমেন ও উত্তর কোরিয়ার নাগরিকরা যদি প্রমাণ করতে না পারেন যে তারা পাঁচ বছর নিজ দেশের বাইরে থেকেছেন, তাহলে তাদেরকে নাগরিকত্ব দেয় না ভানুয়াতু। কিন্তু, গার্ডিয়ানের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, এই দেশগুলোতে বসবাসরত অবস্থায়ই অনেককে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে।
সিরীয় রিয়েল এস্টেট ম্যাগনেট আব্দুল রহমান খিতির ওপর আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর তিনি ভানুয়াতুর নাগরিকত্ব কেনেন। অবশ্য ভানুয়াতুর সিটিজেনশিপ অফিস এন্ড কমিশনের দাবি, নিষেধাজ্ঞা আরোপ হওয়ার বেশ কিছুদিন আগেই নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছিলেন খিতি। তাদের আরো দাবি, খিতি সিরিয়ার বাইরে পাঁচ বছর বাস করার প্রমাণ পেশ করেছিলেন।
আয়ের বড় উৎস:
ভানুয়াতু পৃথিবীর সবচেয়ে গরিব দেশগুলোর একটি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশটি দেনার দায়ে জর্জরিত। ২০১৪ সালের ভয়াবহ সাইক্লোনে দেশটি ভয়ানক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পাসপোর্ট বিক্রি থেকে প্রাপ্ত টাকা দিয়ে ঋণ শোধ করছে ভানুয়াতু। করোনা মহামারীর বিরুদ্ধে লড়তেও দেশটিকে সাহায্য করেছে পাসপোর্ট বিক্রির টাকা।
এভাবে টাকার বিনিময়ে পাসপোর্ট বিক্রির কিছু অসুবিধা থাকলেও ভানুয়াতুর মতো সীমিত সম্পদের একটি দেশের জন্য এই ব্যবস্থা বেশ উপকারী। ভানুয়াতু সরকার অবশ্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, পাসপোর্ট দেওয়ার প্রক্রিয়ায় তারা আরো স্বচ্ছতা আনবে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে ইউরোপের একটি দক্ষ আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করার প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে বলে দাবি করেছে দেশটি।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান