নিভৃত পল্লীতে আলো ছড়াচ্ছে ‘সংশপ্তক’
তখনও ঢেলে সাজানো হয়নি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিকে। করোনায় আক্রান্ত মানুষের কাছাকাছি যাওয়া তো দূরের কথা, করোনায় আক্রান্ত মানুষের বাড়ি; কখনো কখনো গ্রামের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়াটাকেও ভয়ের কারণ মনে হতো মানুষের, ঠিক তখনই আশার আলো জ্বেলে উপজেলার মানুষের সামনে হাজির হয় টিম 'সংশপ্তক'।
সংশপ্তক একটি সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। গত বছরের মার্চে প্রথম লকডাউন শুরু হওয়ার আগে থেকে নাঙ্গলকোট উপজেলায় নানা সেবামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে চলেছে সংগঠনটি। পাশাপাশি করোনায় আক্রান্ত ও এলাকার সাধারণ মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করে তারা।
সংগঠন সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের ২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে টিম সংশপ্তক। শুরুতে ২৬৬ জন সাধারণ শিক্ষার্থী, ১৩ ডাক্তার ও ৪১ জন মেডিকেল শিক্ষার্থী যুক্ত হয় সংগঠনটিতে। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ১২৩৫ জন। নাঙ্গলকোটের ১৬টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় কাজ করছেন একজন করে টিম লিডার। যাদের অধীনে ৫০-এর অধিক সদস্য কাজ করছেন। এখন পর্যন্ত তিন ধাপে প্রায় ১৬ লাখ টাকার সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে সংশপ্তক। উপজেলার প্রায় ৪০ হাজার মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে সেবা কার্যক্রম। বিভিন্ন সভা করে এলাকার বিত্তবানদের উদ্বুদ্ধ, প্রবাসীদের সহায়তা ও নিজেদের অর্থায়নে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করছে সংশপ্তক।
প্রথম পর্যায়ে গত বছরের মার্চে সংশপ্তক টিমের সদস্যের নিজস্ব অর্থায়নে ১৬ ইউনিয়ন ও পৌরসভায় জীবাণুনাশক প্রয়োগ করে সদস্যরা। জীবাণুনাশক প্রয়োগের পাশাপাশি উপজেলার সাত শতাধিক মানুষের মাঝে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ, ২৫০০ মানুষের মাঝে মাস্ক বিতরণ, জনসচেতনতামূলক প্রচার কার্যক্রম, বিদেশ ফেরত ব্যক্তিদের সচেতন করে তোলা, বাড়িতে কোয়ারেন্টিন করায় তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী কিনে দেওয়াসহ আরো অনেক সহায়ক কার্যক্রম চালায় টিম সংশপ্তক।
লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়াদের জন্য সংশপ্তক টিম খাবারের সহায়তায় এগিয়ে আসে। ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখে উপহার হিসেবে নাঙ্গলকোট উপজেলার স্থানীয় ও প্রবাসীদের থেকে অনুদান সংগ্রহ করে নাঙ্গলকোট উপজেলায় একসাথে এক হাজার ৭০০ অসহায় দরিদ্র ও দিনমজুর কর্মহীন পরিবারের মাঝে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হয়। রাতের আঁধারে এই খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেয় সংশপ্তক টিমের সদস্যরা।
এখনো পর্যন্ত ৬৫০ এর অধিক মানুষকে দেয়া হয়েছে টেলি মেডিসিন সেবা। মানুষের জরুরি প্রয়োজনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেবা দিয়েছে সংশপ্তকের মেডিকেল টিমের সদস্যরা।
দ্বিতীয় পর্যায়ে সাংবাদিক নঈম নিজামের অর্থায়নে চালু করা হয় 'হ্যালো সংশপ্তক' নামক আরেকটি কার্যক্রম। 'হ্যালো সংশপ্তক'র মাধ্যমে উপজেলার মধ্যবিত্ত, কর্মহীন পরিবার ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের মাঝে জরুরি উপহার সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হয়। এই কর্মসূচির আওতায় ৯৪টি কর্মহীন মধ্যবিত্ত পরিবার এবং ৬০ জনের বেশি অসচ্ছল শিক্ষার্থীর মাঝে খাবার, নগদ অর্থ ও উপহার সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হয়। হ্যালো সংশপ্তকের আওতায় প্রতিজনকে ১৫০০ টাকা মূল্যের খাদ্যসামগ্রী প্রদান করা হয়।
উপজেলার একজন বিধবা নারী পাঁচ মেয়ে নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন শুনে সেই বিধবার পাশেও দাঁড়ায় সংশপ্তক টিম। দুইদিন অনাহারে থাকা নারীটির বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হয় খাদ্য সামগ্রী। পাশাপাশি চারচালা বিশিষ্ট টিনশেডের একটি ঘর নির্মাণ করে দেয় সংশপ্তক। কাজ করার মতো কোন পুরুষ না থাকায় দেওয়া হয় সেলাই মেশিন। মহিলার ছোট মেয়ের পড়াশোনার যাবতীয় দায়িত্ব নেয় সংশপ্তক টিমের সমন্বয়ক জহিরুল ইসলাম।
কোভিড-১৯ আক্রান্ত মানুষের পাশে যেখানে তাদের পরিবারও থাকছেন না সেখানে সংশপ্তক টিম সেই মানুষদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছে। সার্বক্ষণিক তাদের সাথে যোগাযোগ করেছে, মানসিকভাবে শক্তি যোগানোর চেষ্টা করেছে।
এছাড়া করোনার নমুনা সংগ্রহের বুথ স্থাপন করে সংশপ্তক টিম। গত রমজানে ৩৫০ জন ছিন্নমূল ও অসহায় মানুষকে সেহরি এবং ৪৫০ জনকে ইফতার করায় টিম সংশপ্তক।
তৃতীয় ধাপে নাঙ্গলকোটে চালু করা হয় বিনামূল্যে 'সংশপ্তক অক্সিজেন সেবা'। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাঝে বিনামূল্যে পৌঁছে দেয়া হয় অক্সিজেন সিলিন্ডার। এই অক্সিজেন সেবা এখন পর্যন্ত চলমান রয়েছে। এর মাধ্যমে বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা পেয়েছেন ৬৫ জন করোনা রোগী। অক্সিজেন সেবায় সহযোগিতা করছে নাঙ্গলকোট পাটোয়ারী জেনারেল হাসপাতাল।
সংশপ্তকের সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী জহিরুল ইসলাম জানান, 'বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর গ্রামে চলে আসি। করোনার ভয় তখন চরমে। লকডাউন শুরু হওয়ার আগে ভাবলাম মানুষের সেবায় কী করা যায়। প্রথমে মাত্র তিনজন দিয়ে শুরু করি। তিন-চারদিনের ব্যবধানে ব্যাপক সাড়া পাই। এক লাফে প্রায় ৩০০ মানুষ এগিয়ে আসে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ভালোই চলছে আমাদের কার্যক্রম।'
নাঙ্গলকোট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা লামইয়া সাইফুল বলেন,' সংশপ্তক দারুণ কাজ করছে। আমি সবসময় তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করছি।'