ইউক্রেনকে দেয়া মার্কিন অস্ত্রের চালান চূড়ান্ত যুদ্ধ প্রস্তুতির ইঙ্গিত দিচ্ছে!
ইউক্রেন যুদ্ধে এতদিন আধিপত্য করেছে উভয়পক্ষের দূরপাল্লার কামান ও রকেটের ব্যবহার। এবার তা বদলাতে পারে আক্রমণ পরিকল্পনায়। রাশিয়ার দখলে থাকা কৌশলগত বন্দর শহর–খেরসন এ বছরেই মুক্ত করতে চায় ইউক্রেন। পরিকল্পনা করছে অভিযানের। মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর- পেন্টাগন ইতোমধ্যেই নিকট দূরত্বে লড়াই করার অস্ত্রও দিচ্ছে ইউক্রেনকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো এলাকা শত্রুর দখলমুক্ত করতে, সেখানে শত্রুর অবস্থান লক্ষ করে প্রথমে দূরপাল্লার ভারী কামান দিয়ে গোলাবর্ষণ, রকেট ও বিমান হামলা চালানো হয়। এতে তাদের প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে পড়ে। এর পর প্রতিপক্ষকে পুরোপুরি পরাস্ত করতে হলে চাই পদাধিক ও সাঁজোয়া বাহিনীর অভিযান। আর নিকট দূরত্বে লড়াই বা ক্লোজ কমব্যাট- তখন এড়ানো যায় না।
ঠিক একারণেই ইউক্রেনীয় বাহিনী যাতে ক্লোজ কমব্যাটে রুশ সেনাদের পরাস্ত করতে পারে– এমন ধরনের অস্ত্র ও সরঞ্জাম দিচ্ছে পেন্টাগন।
কিয়েভ ও পশ্চিমারা মনে করছে, আসন্ন শীতের আগে রুশ বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে কিছু এলাকা দখলমুক্ত করার এটাই মোক্ষম সময়। বিগত অনেক সপ্তাহ ধরে চলে আসা 'আর্টিলারির' লড়াই তাতে নতুন রূপ নিবে।
ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা এখন বেশ প্রকাশ্যেই আলোচনা করছেন খেরসন দখলমুক্ত করতে অভিযান চালানোর। অথচ এ ধরনের উদ্দেশ্য গোপন রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে সামরিক পরিকল্পনায়। নাহলে সতর্ক ব্যবস্থা নিতে পারে শত্রুপক্ষ। আর তাতে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি বাড়ে কেবল।
তা ছাড়া, রণাঙ্গনের সম্মুখভাগে ইউক্রেনীয়দের প্রস্তুতি তেমন চোখে পড়ে না। দেখা যাচ্ছে না- তেমন বড় সংখ্যায় সেনা, সাঁজোয়া যান ও শক্তিশালী নিকট দূরত্বের অস্ত্র সমাবেশ– যা সংখ্যাধিক্যে শক্তিশালী রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে আগ্রাসী অভিযান পরিচালনার জন্য আবশ্যক।
এ ধরনের অস্ত্রের ঘাটতি পূরণের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সাম্প্রতিক অস্ত্রের চালানটি পাঠাচ্ছে পেন্টাগন। এতে পাল্টা-আক্রমণ চালানোর ক্ষমতাও বাড়বে ইউক্রেনের।
এমন সরঞ্জামও পাঠানো হচ্ছে যা মাইন বেছানো এলাকা পেরিয়ে শত্রুর ওপর আক্রমণ চালাতে সহায়তা করবে।
খেরসনে রুশ সেনারা রয়েছে বাঙ্কার, পরিখাসহ শক্তিশালী নিরাপদ অবস্থানে। বিছিয়ে রেখেছে মাইন। তাদের হঠাতে এসব সরঞ্জাম খুবই দরকার কিয়েভের।
তবে সফল হামলা চালাতে হলে দূর, মাঝারি ও নিকট পাল্লা– সব ধরনের দূরত্ব থেকেই সফল হামলা চালানোর সক্ষমতাও থাকা চাই।
বিষয়টি মাথায় রেখে গত শুক্রবার ইউক্রেনের জন্য নতুন করে ৮০ কোটি ডলারের এক সামরিক সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে পেন্টাগন। এরমধ্যে আছে বোমা-সহনশীল বিশেষ ধরনের যান, যাদের অগ্রভাগে থাকে মাইন-বিনাশী এক ধরনের ঘুরন্ত চেইন। আরও থাকছে হালকা কামান, যা সহজে আক্রমণ অভিযানের সময়- প্রয়োজন অনুসারে এক স্থান থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া যায়। এর আগে ইউক্রেনকে তুলনামূলক দূরপাল্লার ভারী কামানই দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
মাত্র কয়েক শ' মিটার দূরে গোলা নিক্ষেপে সক্ষম রিকয়েললেস রাইফেলও দিচ্ছে পেন্টাগন। তিন মাইলের কম পাল্লার মিসাইল লঞ্চারও দিচ্ছে। বর্তমানে রাশিয়া ও ইউক্রেনীয় বাহিনী পরস্পরের থেকে যতটা দূরত্বে রয়েছে–এ ধরনের মিসাইলের পাল্লা তার চেয়েও কম। অর্থাৎ, এটির সংযোজন আক্রমণ অভিযানের প্রস্তুতিরই ইঙ্গিতবহ।
শুক্রবার পেন্টাগনের একজন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, 'মাইন বিনাশী যান ইউক্রেনকে দেয়া সহায়তার ভালো উদাহরণ। এর সাহায্যে ইউক্রেনীয় বাহিনী সম্মুখভাগে হামলা চালিয়ে দখলকৃত এলাকা মুক্ত করতে পারবে'।
নাম না প্রকাশের শর্তে ওই কর্মকর্তা আরও বলেছেন, 'দক্ষিণ ইউক্রেনের পরিবেশ (খেরসনও এখানেই) সেনা চলাচলের জন্য খুবই প্রতিকূল। ইউক্রেনীয় বাহিনীও এখানে গতিশীলতার দিক দিয়ে সুবিধে করতে পারছে না। আমাদের দেয়া সহায়তা তাদের এই সক্ষমতা বাড়াবে'।
ইরাক ও আফগানিস্তানে বিদ্রোহীদের পেতে রাখা মাইন ও বিস্ফোরকে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয় দখলদার মার্কিন সেনাদের। এজন্য এক পর্যায়ে মাইন রেজিস্ট্যান্ট অ্যামবুশ প্রটেক্টেড- এমআরএপি যান ব্যবহার শুরু করে তারা। বাহনটি এর যাত্রী সেনাদের বিস্ফোরণের আঘাত ও হালকা আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি থেকে সুরক্ষা দিতে পারে। সামনে থাকে একটি রোলার, যা মাইনের ওপর চাপ দিয়ে সেটির বিস্ফোরণ ঘটায়।
মার্কিন সহায়তার দিশায় এবারের পরিবর্তন লক্ষণীয়। মাস দুয়েক ধরে ইউক্রেনকে হাইমার্সের মতো লক্ষ্যবস্তুতে প্রায় নির্ভুল হামলা চালাতে সক্ষম, এমন দূরপাল্লার রকেট ও নিক্ষেপক যান সরবরাহকে বেশি গুরুত্ব দেয় আমেরিকা।
পূর্বে ডনবাস অঞ্চলে রুশ বাহিনীর অগ্রযাত্রা রুখতে দেয়া হয় হাইমার্স। এটি ব্যবহার করে রুশ বাহিনীর বেশকিছু গোলাবারুদের ডিপো উড়িয়ে দেওয়ার সফলতাও পায় ইউক্রেন। কিন্তু, তাতে রণাঙ্গনের সম্মুখভাগের নিয়ন্ত্রণে তেমন পরিবর্তন আসেনি।
জ্যেষ্ঠ ওই মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেছেন, 'আমরা এলাকা পুনর্দখলের কোনো উল্লেখযোগ্য নজির দেখিনি, তবে এটা ঠিক– কিছু কিছু জায়গায় রাশিয়ানদের অবস্থান দুর্বল হয়েছে'।
এর আগেও পাল্টা-আক্রমণ চালিয়ে রাশিয়ার দখলীকৃত এলাকায় প্রবেশে হিমশিম খেয়েছে ইউক্রেনীয় সেনারা। যেমন গত জুনে খেরসনের কাছে কয়েকটি গ্রাম দখলে নেওয়ার সময় তাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতিও হয়।
তার ওপর সমভূমির যুদ্ধে রুশ বাহিনীর গোলন্দাজ শক্তির মুখে তাদের অগ্রগতি থমকে গেছে। শত্রুপক্ষের অবস্থান নির্ণয়ে রাশিয়ানদের রিকননেন্স মিশনগুলিও পাচ্ছে সাফল্য। এমন অভিযানের মাধ্যমে তারা ইউক্রেনীয় বাহিনীকে আক্রমণে প্ররোচিত করছে– আর একবার শত্রুর অবস্থান স্পষ্ট হওয়া মাত্রই সেখানে গোলাবর্ষণ করছে।
এই কৌশলে যখন ইউক্রেনীয়রা পর্যদুস্ত হচ্ছিল–তখনই হাইমার্স-সহ অন্যান্য দূরপাল্লার কামান দেয় পশ্চিমারা।
এবার ইউক্রেনকে টো (TOW) ট্যাংক বিধ্বংসী মিসাইলও দেয়া হচ্ছে। হামভি যানের ওপরে ট্রাইপডের সাহায্যে স্থাপন করা যায় এর নিক্ষেপক বা লঞ্চার। মিসাইল নিক্ষেপের পর দ্রুত অন্যত্র সরে যেতে পারে হামভি। এই কৌশলকে বলা হয় 'শ্যুট অ্যান্ড স্কুট'। এতে শত্রুর পাল্টা হামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই বাড়ে।
হামভি যানের ১০৫ মিলিমিটার ক্যালিবারের হালকা হাউইৎজার কামান টেনে নিয়ে যেতে পারে। তুলনামূলক বেশি ভারী এম৭৭৭ কামানের চেয়ে এটি টেনে নেওয়াও সহজ, যা ইউক্রেনকে এর আগে দিয়েছিল আমেরিকা।
মার্কিন চিন্তক সংস্থা- ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো রব লি বলেন অবশ্য সতর্ক করে বলেছেন, নতুন প্যাকেজ সহায়তা মানেই ইউক্রেন অচিরেই আক্রমণে যাচ্ছে এমনটা ধরে নেওয়া যাবে না। যেমন- এমআরএপি যান বেশ উঁচু হওয়ায় সমভূমিতে শত্রুপক্ষ এর উপর দূর থেকেই হামলা চালাতে পারবে। কাছাকাছি দূরত্বের যুদ্ধে তাই এটি আদর্শ সমাধান নাও হতে পারে। তবে এটি বর্মহীন ট্র্যাকের চেয়ে ভালোভাবে সেনাদের সুরক্ষা দিতে পারে।
অন্যান্য অস্ত্রগুলি হয়তো নিজস্ব ঘাটতি মেটাতে দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেনকে দূরপাল্লার সরঞ্জাম দিয়ে মার্কিন সেনাবাহিনীর সংঘাতের জন্য প্রস্তুত থাকার সক্ষমতায় যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে– সেটি পূরণেই হয়তো এবার অন্য ধরনের আধুনিক অস্ত্র দিচ্ছে। তাছাড়া, ইতোমধ্যেই হামভি, এমআরএপি এবং টো মিসাইলের মতো অস্ত্র ও বাহন সার্ভিস থেকে অবসরে পাঠানোর কথা ভাবছে মার্কিন সেনাবাহিনী।
- সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট