যেভাবে দেশের বাইরে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের কাছে দেশভাগের গল্প বলছে ‘মিস মার্ভেল’
দর্শকদের মধ্যে ইতোমধ্যেই প্রশংসা কুড়িয়েছে মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের নতুন ডিজনি প্লাস সিরিজ 'মিস মার্ভেল'। ভক্তরা যখন পরবর্তী সিজনের অপেক্ষা করছেন, তখন দেশের বাইরে বেড়ে ওঠা দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় প্রজন্মের দক্ষিণ এশীয়দের অনেকেই পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের নিয়ে আবারও দেখতে বসেছেন এই সিরিজ।
পাকিস্তানি-আমেরিকান মুসলিম এক কিশোরীর সুপারহিরো হয়ে ওঠার গল্প মিস মার্ভেল। সিরিজের একটি অংশে উঠে এসেছে ৭৫ বছর আগে দেশ বিভাজনের করুণ গল্প।
ভারতবর্ষ ছেড়ে যাওয়া ব্রিটিশ শাসকরা ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্তরেখা টেনে দিয়ে যায়। দুই দেশের অন্তত এক কোটি ২০ লাখ মানুষ সেসময় ভিটে ছেড়ে সীমান্তের অপর প্রান্তে পাড়ি জমায়। বাস্তুচ্যুত মানুষদের ভোগান্তি স্রেফ সেখানেই থেমে ছিল না। দাঙ্গা-হাঙ্গামায় আরও অন্তত ২০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।
কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীরা সেসব কথা কতটুকু জানেন? কতটুকু অনুধাবন করতে পারেন?
বোস্টনের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ২০ বছর বয়সী সাহার আরশাদ তাঁর দাদীকে নিয়ে মিস মার্ভেল দেখছেন।
সাহারের দাদী সেই বাস্তুচ্যুত হতভাগ্যদের একজন। ভারতের হায়দ্রাবাদ থেকে দেশ বিভাজনের সময় পাকিস্তানে পাড়ি জমান তিনি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশভাগের সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা প্রায় সারা জীবনই এক অদৃশ্য ক্ষত বয়ে নিয়ে বেরিয়েছেন। এমনকি তাদের উত্তরসূরীরাও বিষয়টি কখনো ভুলতে পারবে না।
পাকিস্তানের লাহোর ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সের পোস্টকলোনিয়াল স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক ফারুখ খান বলেন, 'তারা নিজের চোখে সহিংসতা দেখেছেন। এটা এমন ক্ষত যা আসলে কখনো সাড়ে না'।
২৫ বছর বয়সী রিয়া মজুমদারের জন্ম ও বেড়ে ওঠা নিউ জার্সিতে। ছোট থেকেই দাদা-দাদীদের কাছে দেশভাগের গল্প শুনেছেন। মার্ভেল সিরিজ দেখার পর তিনি বলেন, 'সত্যিই খুব বাস্তব মনে হচ্ছিল। আমার কাছে মনে হয়েছে যেন সরাসরি দেখছি'।
সিরিজের ফিফথ এপিসোডে প্রধান চরিত্র কমলা খান টাইম ট্রাভেলে অতীতে ফিরে যান এবং নিজ চোখে দেশভাগের সময় দেখতে পান। দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত অসংখ্য তরুণ-তরুণী এবারই প্রথম ইংরেজি ভাষার কোনো শোতে দেশভাগের গল্প দেখতে পেয়েছে। প্রথমবারের মতো অনেক পশ্চিমা দর্শকরাও সেসব ইতিহাস জানতে পেরেছেন।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ব্রিটিশ ইমপেরিয়াল হিস্ট্রি বিশেষজ্ঞ ও সিরিজ নির্মাণের কনসালটেন্ট প্রিয়া সাটিয়া বলেন, 'এটা বেশ বড় মাইগ্রেশন ছিল, ইতিহাসের সবচেয়ে বড় একটি স্থানান্তরের ঘটনা। কিন্তু তারপরেও অনেকেই স্রেফ এই শো দেখার পর প্রথমবারের মতো ৪৭-এর দেশভাগের ঘটনা শোনার কথা জানান'।
'সিরিজ নির্মাতাদের দলে লেখক থেকে শুরু করে প্রযোজক ও পরিচালকরা মিলিতভাবে দেশভাগের গল্পের মানবিক দিকগুলো ফুটিয়ে তোলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। এরকম বেদনাদায়ক এপিসোড নির্মাণের বিষয়ে তারা বেশ সংবেদনশীল ছিলেন। আর কী চমৎকার ঐতিহাসিক ঘটনাবহুল এপিসোডই না হয়েছে সেটি,' বলেন তিনি।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বিনোদন জগতে দেশ বিভাজনের বিষয়গুলো উঠে আসলেও সেগুলোতে মানবিক দিকের পাশাপাশি এখনও রাজনৈতিক বিভিন্ন এজেন্ডা উঠে আসে।
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য সতর্ক করে বলেছেন ফিকশনাল কোনো চিত্রায়ন এমনকি মিস মার্ভেলে দেশভাগের চিত্রায়নেও যে একদম সঠিক ও পুঙ্খানুপুঙ্খ ইতিহাস উঠে এসেছে তা মনে করা ঠিক হবে না। তবে এই চিত্রায়ণ ইতিহাসের গল্পগুলোকে যেমন তুলে এনেছে তেমনই দেশভাগের সময় নারীদের করুণ অভিজ্ঞতার মতো বিষয় যেগুলো বরাবরই উপেক্ষিত থেকে গেছে, সেগুলোকেও সামনে এনেছে।
বোস্টনের টাফটস ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক আয়শা জালাল বলেন, 'দেশভাগের স্মৃতিগুলো এর মধ্য দিয়ে আবারও জেগে উঠেছে। আমার মনে হয় এটা ভালো। তবে এটি কাল্পনিক এক চিত্রায়ন। আমি বলব দর্শকদের এটা বিনোদনের অংশ হিসেবেই দেখা উচিত হবে, ইতিহাসের পাঠ হিসেবে নয়'।
- সূত্র: এনবিসি নিউজ