স্বামীর নামের অংশ নিজের নামের সঙ্গে আর যুক্ত করতে চায় না জাপানের মেয়েরা!
জাপান বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানে বিয়ের পর স্বামী বা স্ত্রীকে একই নাম ব্যবহার করতে হয়। তবে কয়েক দশক থেকে চলা এই নিয়ম পরিবর্তনের জোর দাবি উঠেছে জাপানে।
বিয়ের পরই আকিকো সাইকাওয়াক প্রশাসনিক ঝামেলার শিকার হন। তার পাসপোর্টসহ অন্যান্য কাগজাদি এবং এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নাম পরিবর্তন করতে ডজনখানেক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল। কারণ আইন অনুসারে দেশটিতে বিবাহিত নারীদের তার শেষ নাম বা পদবি পরিবর্তন করতে হয়।
জাপানে দম্পতিরা বিয়ে করার সময় কোন নামটি গ্রহণ করবেন তা নির্ধারণের স্বাধীনতা থাকলেও ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রে অনিচ্ছা সত্ত্বেও নারীরাই তা পরিবর্তন করেন। স্বামীর নামই গ্রহণ করেন তারা।
সাইকাওয়া বলেন, 'নাম পরিবর্তনের এ প্রক্রিয়া খুব সময়সাপেক্ষ এবং অসুবিধাজনক ছিল। তবে সবচেয়ে ঝামেলার বিষয় ছিল আমাদের পারিবারিক রেজিস্টারে আমার নাম পরিবর্তন করে আমার স্বামীর নাম রাখা হয়েছিল। আমাকে আমার অফিসে এটা পরিষ্কার করতে হয়েছিল যে, কর্মক্ষেত্রে যেন আমার প্রথম নাম দ্বারাই আমাকে সম্বোধন করা হয়।'
বিবাহিত দম্পতিদের একই নাম ভাগ করে নেওয়ার আইনটি জাপানে লিঙ্গ বৈষম্যের পুরানো একটি আইন। একটি সরকারি প্যানেল ১৮০০ শতকের শেষের দিকে গৃহীত। আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নিলেও তিন দশক ধরে তা নিষ্ক্রিয় ছিল।
এই বিষয়ে মানবাধিকার কর্মীরা যুক্তি দেখান যে, জাপানে বিবাহিত দম্পতিদের একই নাম ভাগ করে নেওয়ার এ রীতি লিঙ্গ সমতার ক্ষেত্রে দেশটির ধীর অগ্রগতিকে তুলে ধরে।
জাপান উইমেন্স ইউনিভার্সিটির শ্রম অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মাচিকো ওসাওয়া এই অগ্রগতির অভাবকে ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মধ্যে যারা ঐতিহ্যগত রীতিনীতি বজায় রাখেন তাদের মধ্যে 'পুরানো ধাঁচের পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব' কে দায়ী করেছেন।
তিনি বলেন, 'নবদম্পতি নারীদের ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট, ক্রেডিট কার্ড, পাসপোর্ট এবং অন্যান্য সমস্ত অফিসিয়াল নথিতে তাদের নাম পরিবর্তন করতে অনেক সময় নষ্ট করতে হয়। আর যারা নিজেদেরকে পেশাজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাদের নাম পরিবর্তন করতে বাধ্য করা মানে তারা যা অর্জন করেছেন তা অস্বীকার করা। এটি বিভ্রান্তির তৈরি করে এবং তাদের পুরুষদের অধীনস্থ করে।'
কর্মক্ষেত্রে হয়রানি
বিবাহিত দম্পতিদের একই পদবি নেওয়ার এ আইন পরিবর্তনের জন্য জাপানের ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) ওপর চাপ বাড়ছে। সিনিয়র ব্যবসায়ী নেতারাও যুক্তি দিচ্ছেন যে, এই নিয়মটি বিদেশে ব্যবসা করা জাপানি সংস্থাগুলোকে বাধা দিচ্ছে।
শিসেইডোর সিইও মাসাহিকো উওতানি জানান, নারী নির্বাহীরা বিদেশে ব্যবসায়িক ভ্রমণের সময় সমস্যার মুখোমুখি হন। কারণ তাদের পরিচয়পত্র তাদের পদবির সাথে মেলে না।
বিষয়টি সম্পর্কে জাপান বিজনেস ফেডারেশনের এক সভায় উওতানি বলেন, 'যেসব নারীরা কাজের জন্য বিদেশ ভ্রমণ করেন, তাদের জন্য বর্তমান ব্যবস্থা ক্যারিয়ার উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।'
জাপান বিজনেস ফেডারেশন (কেইডানরেন) পেশাদার নারীদের কাছ থেকে এই বিষয়ে সাক্ষ্য সংগ্রহ করেছে যারা এরকম একক নাম থাকার কারণে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ সংস্থাগুলো নারীদের তাদের মূল উপাধি রাখার অনুমতি দিলেও বিদেশ ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত ডকুমেন্টেশন সাথে রাখার সমস্যা এখনও রয়ে গেছে।
শ্রম প্রশাসন ইনস্টিটিউটের ২০২২ সালের জরিপ অনুসারে, দেশটির প্রায় ৮৪ ভাগ সংস্থাগুলো কর্মক্ষেত্রে নারীদের তাদের মূল পদবি রাখার অনুমতি দেয়।
কেইডানরেন এখন এই আইন পরিবর্তনের প্রচারণায় যুক্ত হয়েছে। যা জাপানি কর্পোরেট সংস্কৃতিতে একটি পরিবর্তনকে তুলে ধরে। তবে, রক্ষণশীল এলডিপি সদস্যরা যুক্তি দেখান যে, নাগরিক কোড পরিবর্তন করা ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক মূল্যবোধকে ব্যাহত করবে এবং সম্ভাব্যভাবে শিশুদেরকে বিভ্রান্ত করবে।
তবুও, অধ্যাপক ওসাওয়ার মতো সমালোচকরা এই যুক্তিটি প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন যে, বর্তমান আইনটি পারিবারিক স্থিতিশীলতা সমর্থন করে না।
যদিও প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা এই পরিবর্তনের পক্ষে বিস্তৃত সমর্থন আদায়ের জন্য আরও আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন। অনেক নারী পৃথক উপাধি গ্রহণে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। এ পরিবর্তন বিয়ের পরে তারা যে আমলাতান্ত্রিক চ্যালেঞ্জগুলির মুখোমুখি হয় তা দূর করবে এবং তাদের পেশাদার পরিচয় বজায় রাখার অনুমতি দেবে।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন