বিশ্বের দীর্ঘতম জাহাজের উত্থান, পুনর্জন্ম এবং পতন
আপনারা হয়ত বেশিরভাগই টাইটানিক সম্পর্কে জানেন। কিন্তু সিওয়াইজ জায়ান্ট নামের জাহাজটি সম্পর্কে আপনাদের কাছে খুব বেশি তথ্য থাকার কথা নয়। এই জাহাজটির একটি অসাধারণ গল্প রয়েছে।
সিওয়াইজ জায়ান্ট ছিল বিশ্বের দীর্ঘতম এবং সবচেয়ে ভারী জাহাজ যার দৈর্ঘ্য ছিল ১ হাজার ৫০৪ ফুট। জাহাজটির ৫ লাখ ৬৪ হাজার টনের বেশি কার্গো ধারণক্ষমতা ছিল। এটি আইফেল টাওয়ার এবং এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং এর থেকেও দীর্ঘ ছিল।
ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের নির্দেশে জাহাজটিতে একটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছিল। হামলায় জাহাজটি ডুবে যাওয়ার পর এটিকে আবারো পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল।
হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্প প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ অ্যান্ড্রু বয়েড বলেছেন, "জাহাজটির ডেক ছয়টি ফুটবল মাঠের চেয়েও বড় ছিল। এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ছিল ১৫০০ ফুট যা এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের চেয়ে লম্বা।"
সিওয়াইজ জায়ান্ট দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে যাত্রা করেছে। যখন এটি শেষ যাত্রা করে তখন এটিকে স্ক্র্যাপ হিসেবে ভেঙে ফেলতে এক বছরেরও বেশি সময় এবং ১৮ হাজার শ্রমিক লেগেছিল। সিওয়াইজ জায়ান্টের মতো বড় জাহাজ আর কেউ তৈরি করেনি।
সিওয়াইজ জায়ান্টের নির্মাণ
১৯৭০-এর দশকের শেষের দিক, টোকিওর সুমিটোমো হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ একটি বিশাল সুপার ট্যাংকার তৈরির জন্য একজন গ্রিক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে একটি নির্দেশনা পায়।
১৯৭৯ সালে যখন জাহাজটির নির্মাণকাজ প্রায় শেষ হয়ে আসে তখন ঐ ব্যবসায়ী পিছিয়ে পরেন। কেউ কেউ বলেন, তিনি দেউলিয়া হয়েছিলেন আবার অন্যরা দাবি করেন, তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন। তবে তার পিছিয়ে পরার সঠিক কারণটি অজানা রয়ে গেছে।
দুই বছর পর হংকং-ভিত্তিক ওরিয়েন্ট ওভারসিজ কনটেইনার লাইনের (ওওসিএল) মালিক তুং চাও ইউং সুমিতোমোর সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি সুপার ট্যাংকারটি কিনতে চেয়েছিলেন কিন্তু একটি শর্তে: এটি আকারে বড় হতে হবে।
সুমিতোমো রাজি হয় এবং যখন ইউং-এর কোম্পানি সুপার ট্যাংকারটি বুঝে পায় তখন এটি ২৩০ টনের রুডার (স্টিয়ারিং সিস্টেম) সহ ১ হাজার ৫০৪ ফুট লম্বা ছিল।
ইউং এর নাম দিয়েছিলেন 'সিওয়াইজ জায়ান্ট'।
এত বড় সুপার ট্যাংকার এর আগে সমুদ্রে দেখা যায়নি। এটি এত বড় ছিল যে এটি ঘুরানোর জন্য কমপক্ষে ২.৭১৯ বর্গ মাইল খালি স্থানের প্রয়োজন ছিল। ১৬.৫ নট (প্রায় ৩০.৫ কিমি/ঘণ্টা) সর্বোচ্চ গতিতে চললে জাহাজটি থামাতে আরও ৫.৬ মাইল খালি স্থানের প্রয়োজন ছিল।
সিওয়াইজ জায়ান্টের মতো একটি বড় জাহাজকে দ্রুত থামানোর পদ্ধতি ব্যবহারিক বা নিরাপদ ছিল না। কারণ এর বিশাল আকারের কারণে তৈরি হওয়া জড়তা অনেক বেশি ছিল যার ফলে এটিকে দ্রুত থামানোর পদ্ধতি অনেকটা সম্পূর্ণ বোঝাই দ্রুত চলমান একটি বাসকে হঠাৎ থামানোর মতো কঠিন ছিল।
এই চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও সিওয়াইজ জায়ান্ট ছিল ওওসিএল-এর জন্য একটি মূল্যবান সম্পদ। এটি সাত বছর ধরে নিয়মিতভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে অপরিশোধিত তেল পরিবহণ করেছিল।
সিওয়াইজ জায়ান্টের মৃত্যু এবং পুনর্জীবন
ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় ১৯৮৮ সালে সিওয়াইজ জায়ান্টের জন্য সবকিছু বদলে যায়। ১৯৮৮ সালের ১৪ মে জাহাজটি, অপরিশোধিত তেল দিয়ে সম্পূর্ণ বোঝাই অবস্থায় ইরানের লারাক দ্বীপ থেকে প্রস্থান করার সময় ইরাকি বিমান বাহিনী এই এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ শুরু করে।
সিওয়াইজ জায়ান্টের ট্যাংকের তেলে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে আগুন ধরে যায় এবং জাহাজটি দ্রুত আগুনে পুড়ে যায়। এটি মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং অবশেষে ডুবে যায়। তবে জাহাজটির শেষ এখানেই হয়নি।
যুদ্ধের পরে সিওয়াইজ জায়ান্ট ডুবে যাওয়ার কারণে ওওসিএল ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তারা জানত, জাহাজটি কোথায় ডুবেছে। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে উদ্ধারকাজটি লাভজনক না হওয়ায় এটি পুনরুদ্ধার এবং মেরামতের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেয়।
দশ বছর ধরে সিওয়াইজ জায়ান্টের ক্যাপ্টেন হিসেবে দায়িত্ব পালন করা নাবিক সুরিন্দর কুমান মোহন বলেন, 'জাহাজটিকে পুনর্গঠন করা অলাভজনক ঘোষণা করে সেটিকে ব্রুনাই উপসাগরে ফেলে রাখা হয়েছিল৷ কিন্তু জাহাজটির ভাগ্যে অন্য কিছু লেখা ছিল।'
নরওয়ের কোম্পানি নরমাল ইন্টারন্যাশনাল একটি সুযোগ দেখেছিল। তারা জাহাজটি উদ্ধার, মেরামত এবং এটির মালিকানা মেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এতে তাদের লাখ লাখ ডলার খরচ হয়েছিল। কিন্তু তারা ৩ হাজার ৭০০ টন ইস্পাত ব্যবহার করে জাহাজটি ঠিক করতে পেরেছিল।
নরমাল ইন্টারন্যাশনাল সুপার ট্যাংকারটির নাম পরিবর্তন করে 'হ্যাপি জায়ান্ট' রাখে। তবে কোম্পানিটির কাছে জাহাজটি অল্প সময়ের জন্যই ছিল কারণ অনেক ধনী ক্রেতা এটি কেনার আগ্রহ দেখিয়েছিল।
সমুদ্রে সিওয়াইজ জায়ান্টের রাজকীয় প্রত্যাবর্তন
১৯৯১ সালে, নরমাল ইন্টারন্যাশনাল এমন একটি প্রস্তাব পেয়েছিল যা নাকচ করা কোম্পানিটির জন্য অসম্ভব ছিল। নরওয়েজিয়ান শিপিং মোগল জর্গেন জাহরে হ্যাপি জায়ান্টকে ৩৯ মিলিয়ন ডলারে কিনে নেন এবং এর নতুন নাম দেন জাহরে ভাইকিং।
সুপার ট্যাংকারটি তেল পরিবহনের জন্য আবারো ব্যবহার করা শুরু হয়। ক্যাপ্টেন সুরিন্দর কুমার মোহনের নেতৃত্বে ৪০ জন ক্রু এটি পরিচালনার দায়িত্ব নেয়।
এর বিশাল আকারের জন্য এটি মিডিয়ার ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল এবং এর যাত্রা টিভি শো থেকে শুর করে ডকুমেন্টারিতে প্রদর্শিত হয়েছিল।
মোহন বলেন, 'জাহাজটি ব্যাপক মিডিয়া কভারেজ পেয়েছিল। বিবিসির ডিসকভারি চ্যানেল টি. টি. জাহরে ভাইকিং নিয়ে ফিচার করার পাশাপাশি এবং জেরেমি ক্লার্কসন আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছিল।'
'এক্সট্রিম মেশিনস' নামের অনুষ্ঠানটি ভারত সহ বিশ্বব্যাপী দেখানো হয়েছিল। আরেকটি অনুষ্ঠান 'বিল্ডিং দ্য বিগেস্ট' বিশ্বব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে বলে মোহন জানিয়েছেন।
সময়ের সাথে সাথে সমুদ্র বাণিজ্যের নিয়ম এবং প্রয়োজনীয়তা পরিবর্তিত হয়। ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে তেল শিপিং কোম্পানিগুলো ছোট, দ্রুত এবং আরও সহজে পরিচালনা করা যায় এমন জাহাজ পছন্দ করত।
আধুনিক জাহাজের তুলনায় জাহরে ভাইকিং-এর বেশি জ্বালানির প্রয়োজন ছিল এবং পরিচালনা খরচ বেশি ছিল। এর দৈর্ঘ্যের জন্য এটিকে পানামা এবং সুয়েজ খালের মতো সংকীর্ণ বাণিজ্য পথ দিয়ে চলাচল করানো কঠিন ছিল।
এই চ্যালেঞ্জগুলোর জন্য জর্গেন জাহরে বিশ্বের বৃহত্তম জাহাজটি ফার্স্ট ওলসেন ট্যাংকার্সের কাছে বিক্রি করে দেন। কোম্পানিটি সিওয়াইজ জায়ান্টকে সমুদ্রে না পাঠিয়ে সেটি থেকে অর্থ উপার্জন করার একটি গোপন পরিকল্পনা নিয়েছিল।
সিওয়াইজ জায়ান্টের শেষ যাত্রা
২০০৪ সালে ফার্স্ট ওলসেন ট্যাংকার্স জাহাজটি অধিগ্রহণ করে এবং এর নামকরণ করে নক নেভিস। পাঁচ বছর ধরে এটি কাতারের আল শাহীন অয়েল ফিল্ডে একটি স্থায়ী স্টোরেজ সুবিধা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
যখন জাহাজটি আর সঞ্চয়ের জন্য উপযোগী ছিল না তখন এটি ভারতের গুজরাটের একটি শিপ-ব্রেকিং ইয়ার্ডে বিক্রি করা হয় এবং মন্ট নামকরণ করা হয়।
২০০৯ সালের ডিসেম্বরে সিওয়াইজ জায়ান্ট শিপ-ব্রেকিং ইয়ার্ডের উদ্দেশ্যে চূড়ান্ত যাত্রা শুরু করে। পরের বছর ১৮ হাজার কর্মী একে টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলে।
আজ সুপার ট্যাঙ্কারটির একমাত্র অংশ যেটির অস্তিত্ব রয়েছে সেটি হলো এর নোঙর, যার ওজন ৩৬ টন। সেটি হংকং মেরিটাইম মিউজিয়ামে প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে।
মোহন বলেন, 'আমি মনে করি, জাহরে ভাইকিংয়ের আকারের আর একটি জাহাজ আর তৈরি করা হবে কারণ এর নির্মাণ খরচ, সমুদ্রে ব্যবহারকারী জাহাজ নিয়ে নতুন আইন এবং অপরিশোধিত তেলের চাহিদা বিবেচনা করলে এটি আর্থিকভাবে আর লাভবান প্রক্রিয়া হবে না।'
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়