বাংলাদেশি সিইওদের চোখে ভবিষ্যতের সেরা ৫ পেশা
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের ভবিষ্যতের অনেক কিছুই নির্ভর করছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ওপর। এর আগের শিল্পবিপ্লবগুলো থেকে উদীয়মান অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও বিশেষ কোনো সাফল্য অর্জন করতে পারেনি।
বর্তমান সুযোগ হাতছাড়া করার মানে হবে বাংলাদেশ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল ভোগ করা দেশগুলোর তুলনায় প্রাগৈতিহাসিক যুগে অবস্থান করবে। তাই এ হারজিতের খেলায় বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের এখন থেকে ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে পেশা বা চাকরি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সম্ভবত বেশিরভাগ মানুষই সরকারি চাকরিই পছন্দ করেন। দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে সরকারি চাকরিই সবচেয়ে যুতসই বলে মনে হয়। তবে এ লেখায় সরকারি চাকরি নয়, বরং চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু প্রাসঙ্গিক পেশা নিয়েই আলোচনা করা হবে।
আগামী দশকগুলোতে কোন পেশা বা কাজ বেশি গুরুত্ব পাবে সে বিষয়ে জানার জন্য দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড দেশের বিভিন্ন খাতের কয়েকজন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) সঙ্গে কথা বলেছে। তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে ভবিষ্যতের চাকরি হিসেবে তারা কোন পেশাটিকে বেছে নেবেন এবং কেন সে পেশাটি আগামীর চাকরিবাজারে গুরুত্ব পাবে।
বিজনেস অ্যান্ড প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট, ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প
জেনেরিক ঔষধশিল্পে গত এক দশকে বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম নিয়ে কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার হার বেড়ে গেছে। এ ধরনের পরিস্থিতিকে প্রাইস-ওয়ার বা মূল্য-যুদ্ধ বলা হয়। এসব ক্ষেত্রে একটি কোম্পানি তাদের কোনো পণ্য তাদের প্রতিযোগী কোম্পানির একই পণ্যের দামের চেয়ে কম দামে বিক্রি করে।
রেনাটা লিমিটেড-এর সিইও কায়সার কবির বলছেন, ভবিষ্যতে স্পেশালিটি মলিকিউলস খাতের মাধ্যমে পণ্যের উন্নয়ন ও বিকাশ সাধন করে এগুলোর মধ্যে ভিন্নতা আনা যাবে। ফলে বাজারে পণ্যের দাম নিয়ে বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে প্রতিযোগিতা কিছুটা কমে যাবে।
কায়সার কবির মনে করেন ভবিষ্যতের কর্পোরেট সেক্টরের বিকাশের কৌশল হিসেবে এটিই হয়ে উঠবে সবচেয়ে বড় শক্তি। সুতরাং, ব্যবসায় ও পণ্য উৎপাদনের কাজকে একীভূত করে এমন চাকরির প্রাধান্য বেড়ে যাবে আগামী দিনে।
এ ধরনের চাকরির ক্ষেত্রে বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চমাত্রার ধারণা থাকতে হবে বলেও জানান কায়সার কবির। দুটি কারণে বিজ্ঞানের প্রয়োজন হবে। এক, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে রিডিজাইন করার জন্য বিভিন্ন রাসায়নিক অণু খুঁজে বের করা; দুই, সেসব অণুর সাপেক্ষে পণ্য তৈরি করা।
এ ধরনের কাজের মানসিকতা থাকলে একজন শিক্ষার্থীকে জীববিজ্ঞান ও রসায়নে ভালো করার পরামর্শ দিয়েছেন কবির। যারা ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে ক্যারিয়ারে সফলতার দেখা পেতে চান তাদেরকে বিভিন্ন বিষয় যেমন রোগ-প্রতিরোধবিদ্যা, জিনোম, ঔষধবিজ্ঞানসহ আরও অন্যান্য ক্ষেত্রে নিয়মিত আপডেটেড থাকতে হবে বলে জানান তিনি।
ডেটা অ্যানালিস্ট, কর্পোরেট সেক্টর
উন্নয়নশীল যেকোনো অর্থনীতির জন্য মার্কেটিং ও বিক্রয় দুটোর গুরুত্বই সবসময় বজায় থাকবে। ডিজিটাল মার্কেটিং বা সরাসরি মার্কেটিং, দুটোই যেকোনো ব্যবসার ক্ষেত্রে ভীষণ জরুরি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জন্য কনটেন্ট নির্মাণের মাধ্যমে টার্গেট অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছানোর মতো ডিজিটাল মার্কেটারের যেমন দরকার, তেমনিভাবে প্রয়োজন সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট-এরও।
কর্পোরেট সেক্টরের ক্ষেত্রে যেমন গতানুগতিক মার্কেটিং, বিক্রয়, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি ভবিষ্যতেও বহাল তবিয়তে টিকে থাকবে, তেমনিভাবে এ সেক্টরে বিশাল পরিমাণে ডেটা বিশ্লেষণ বা বিগ ডেটা অ্যানালাইসিস-এর গুরুত্বও ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে।
বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুপালি চৌধুরী বলেন, 'বিগ ডেটা অ্যানালাইসিস বড় প্রভাব ফেলবে। এ বিষয়ের পেশাদার ও দক্ষ মানুষদের চাহিদা বেড়ে যাবে বৈশ্বিকভাবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ চাহিদা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাবে।'
ডিজিটাল দুনিয়ায় ডেটা সামলাতে হিমশিম খাবে কর্পোরেট সেক্টর। ফলে যোকোনো কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ডেটা অ্যানালাইসিস বড় ভূমিকা রাখবে। এমনকি কোনো পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে ডেটার ওপর ভিত্তি করে। এসব কারণে যেকোনো ডেটা অ্যানালাইসিসের কাজই কর্পোরেট সেক্টরে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে।
তাদেরকে (ডেটা অ্যানালাইসিস্ট) কম্পিউটারের ওপর শক্তিশালী ভিত অর্জন করতে হবে বলে মন্তব্য করেন রুপালি চৌধুরি। তার মতে, ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) এবং ব্যবাসায় ও প্রযুক্তির একীভূতকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং, রেডিমেইড গার্মেন্টস
তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাতে বর্তমানে পণ্য-উৎপাদন খরচ দ্রুত বাড়ছে। একই অবস্থা শ্রমিক-মজুরি, কাঁচামাল, ও সরবরাহ চেইনের ক্ষেত্রেও। তবে এ খাতে উচ্চ প্রতিযোগিতার জন্য গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলো তাদের পণ্যের দাম বাড়তে পারে না।
বাংলাদেশে শ্রমিকের পেছনে তুলনামূলক কম খরচ করতে হয়, যা এখানকার আরএমজি খাতের জন্য একটি বিশেষ সুবিধা। কিন্তু ভবিষ্যতে আর শ্রমিকের মজুরি সস্তা থাকবে না।
এরকম পরিস্থিতিতে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির যে পেশা সবচেয়ে বেশি ফলপ্রদ আউটপুট দিতে পারবে, তার দাম বেড়ে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন স্প্যারো গ্রুপ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম।
'এ দায়িত্ব যার কাঁধে পড়বে তাকে খেয়াল রাখতে হবে তার কারখানার দক্ষতার ওপর। তাকে নিশ্চিত করতে হবে ওই কারখানায় যেন কর্মী ও যন্ত্রের অনুপাত ঠিক থাকে এবং কর্মীরা তদের সর্বোচ্চ দক্ষতা কাজে লাগান। আর ঠিক এ কাজটি যারা করেন তদেরকে বলা হয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ার (আইই),' বলেন শোভন ইসলাম।
বাংলাদেশে অধিকাংশ বড় পোশাক কারখানাগুলোতে আইই থাকলেও বেশিরভাগ কারখানাতেই এখনো এ পদের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু বর্তমানে দৃশ্যপট এমন হলেও ভবিষ্যতে আইই হবে সবচেয়ে চাহিদাসম্পন্ন পেশা।
শোভন জানান, বাংলাদেশে বর্তমানে দক্ষ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ার-এর সংকট চোখে পড়ার মতো। অনেক ক্ষেত্রেই ভারতীয় ও শ্রীলংকান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ার-এর ওপর নির্ভর করতে হয়।
শোভন মনে করেন, কেউ যদি এখন থেকেই এ পেশার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে, তাহলে ভবিষ্যতে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। তিনি প্রত্যাশা করেন সামনে দেশের গার্মেন্ট কারখানাগুলো বাংলাদেশি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ার দ্বারাই স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে।
রোবোটিকস প্রসেস অটোমেশন, ইনফরমশন টেকনোলজি
বর্তমানে যেভাবে প্রযুক্তির অগ্রগতি হচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে তথ্য প্রযুক্তি (আইটি) খাতে কোন চাকরির চাহিদা বেশি হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
তবে আইটি প্রতিষ্ঠান রাইজআপ ল্যাবস-এর সিইও এরশাদুল হক মনে করেন, আইটি খাতে রোবোটিকস প্রসেস অটোমেশন (আরপিএ)-এর উচ্চ চাহিদা থাকবে।
'সব ধরনের শিল্প খাত অটোমেশন ও ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের দিকে ঝুঁকছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে অটোমেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেদের লভ্যাংশ বাড়ানোর চেষ্টায় আছে এ খাতগুলো,' বলেন হক।
এরশাদুল হকের মতে, শিক্ষার্থীদের একটি প্রযুক্তি বেছে নিয়ে সেটির ওপর কাজ করা উচিত। তাদের উচিত ওই প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা, প্রযুক্তিগুলোর সরাসরি সংস্পর্শে আসার চেষ্টা করা, বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে শেখা, বৈশ্বিক পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা ও খোঁজখবর রাখা, ওই প্রযুক্তির ওপর নিজেদের মনোযোগ ধরে রাখা ও প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট পড়াশোনা করা। আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরে এ খাতের চাহিদা বাড়া শুরু হবে বলেই অভিমত তার।
প্রোডাক্ট ডিজাইন অ্যান্ড ফ্যাসিলিটেশন, কৃষি
কৃষিভিত্তিক স্টার্টআপ ই-খামার-এর উদ্যোক্তা ও সিইও দীপ্ত সাহা বাংলাদেশের কৃষিখাতকে চার অংশে ভাগ করেছেন। এগুলো হচ্ছে ইনপুট (বীজ, সার, কীটনাশক, চারা, যন্ত্রপাতি); অ্যাডভাইজরি (কৃষি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিস্তৃত সেবা, পশু-চিকিৎসা ইত্যাদি); অর্থনীতি (ধার, ঋণ, ভবিষ্যৎ চুক্তি); ও মার্কেট সুবিধা (যথাসময়ে ন্যায্যদামে ফসল বিক্রয়)।
এরকম একটি দৃশ্যপটে প্রোডাক্ট ডিজাইনার ও ফ্যাসিলিটেটরের পদ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেবে বলে মনে করেন দীপ্ত সাহা। 'কৃষিখাতে অনিশ্চয়তা ও গতানুগতিক পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে নতুন নতুন আইডিয়া ও ইনোভেশনের প্রয়োজন। বর্তমানে কৃষকেরা অফলাইননির্ভর হলেও আগামী দিনগুলোতে তাদের প্রয়োজনীয় সেবাগুলো অনলাইনেই পাওয়া যাবে। আর কৃষকদের অফলাইন আর অনলাইনের দূরত্ব ঘোচাতে আমাদের এ খাতে ফ্যাসিলিটেটরের দরকার হবে।'
কৃষি বিষয়ের শিক্ষার্থীদের সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার পরিচালনা করার জন্য আরও প্রাযুক্তিক জ্ঞানের প্রয়োজন হবে। এর পাশাপাশি এসব পেশায় কাজ করতে হলে বাজার পরিস্থিতি ও ভোক্তার আচরণ বুঝতে হবে। কোনো কৃষকই শুধু শুধু চোখ ধাঁধানো প্রযুক্তি আর বইয়ের লেকচার শুনে টাকা ঢালবে না।