চট্টগ্রাম থেকে বিশ্বের প্রধান বন্দরগুলোয় সরাসরি রুটে পণ্য পরিবহনে সময় ও খরচ কমবে অর্ধেক
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি ও রপ্তানির সাথে জড়িত শিপিং লাইনগুলো ও ব্যবসায়ীদের চালান আনা-নেওয়ার সময়টা নিয়ে উদ্বেগেই থাকতে হতো।
যেমন ২০২১ সালের এপ্রিলে শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোয় আটকা পড়েছিল ২৫ হাজারের বেশি আমদানিকৃত পণ্যবোঝাই কনটেইনার। এতে সরবরাহে ভাটা পড়ায় কাঁচামাল সংকটে পড়ে দেশের শিল্পগুলি।
চালান নির্ধারিত সময়ে পৌঁছানো যাবে না এ শঙ্কাতেও অসহায় অবস্থা হতো রপ্তানিকারকদের।
পণ্য ও কাঁচামাল পৌঁছানোর বিলম্ব ব্যাহত করছিল বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলকে। একইসঙ্গে, ফ্রেইট খরচ বা জাহাজে মালবহনের ভাড়া আকাশচুম্বী হয়ে ওঠার কারণে সংকট আরও জটিল হয়েছিল।
নেতিবাচকতার এ দৃশ্যপট খুব শিগগিরই অতীতে পরিণত হতে পারে। এ সংকটকে শেখার সুযোগে পরিণত করে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) দেশি ও বিদেশি শিপিং কোম্পানির সহায়তায় চলতি ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে গেল সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৫-২০টি প্রধান রুটের মধ্যে সাতটিতে সরাসরি শিপিং (জাহাজ চলাচল) পরিষেবা চালু করেছে।
চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি শিপিং বন্দরের গতিশীলতা বাড়ানোর পাশাপাশি চালান পাঠানোর খরচ এবং রপ্তানির লিডটাইম কমিয়েছে।
শিপিং শিল্পের অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিরা বলেছেন, আগে যেখানে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হয়ে এসব গন্তব্যে পৌঁছাতে কমপক্ষে ৪০ থেকে ৪৫ দিন সময় লাগতো, তা এখন নেমে এসেছে ১৫ থেকে ২০ দিনে। এতে শুধু সময় কমেনি, শিপমেন্ট খরচ কমেছে প্রায় কমপক্ষে ৪০ শতাংশ।
এর ফলে আমদানিকারকরাও তাদের পণ্য দ্রুত পাওয়ার আশা করতে পারেন।
প্রথম সরাসরি শিপিং শুরু হয় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চট্টগ্রাম-ইতালি রুটে। বর্তমানে, প্রায় ৮-১০% পণ্য সরাসরি চট্টগ্রাম থেকে ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, তুরস্ক, চীন (হংকং) এবং যুক্তরাজ্যের বন্দরে বহন করা হয়।
সিপিএ আরও রুট চায়। পর্তুগাল, স্লোভেনিয়া, থাইল্যান্ড এবং মধ্যপ্রাচ্যে সরাসরি শিপিং চলতি ২০২২ সালের মধ্যেই শুরু হবে। তবে এর সময়সীমা এখনও চূড়ান্ত করা হয়নি।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ)-র সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, কোস্টাল শিপিং চলছে ভারতের। থাইল্যান্ডের রেনং বন্দরে পণ্য পরিবহনে এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে। সরকারি পর্যায়ের সকল ধরনের অনুমোদন সম্পন্ন হয়েছে। এই রুটেও সরাসরি জাহাজ চলাচল প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ইউরোপে সরাসরি রুট চালু হওয়ায় পোশাক রপ্তানিকারকরা লাভবান হচ্ছেন। লিডটাইম কমেছে এবং এটি দেশের অর্থনীতির জন্য একটি মাইলফলক।
বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, স্লোভেনিয়ায় সরাসরি জাহাজ চলাচল হবে আরেকটি মাইলফলক, কারণ এতে করে জার্মানি এবং পর্তুগালে পণ্য পরিবহন সহজ হবে।
এ বিষয়ে গত ২১ জুন সিপিএর সঙ্গে বৈঠক করে স্লোভেনিয়ার বন্দর কর্তৃপক্ষ।
স্লোভেনিয়ার কোপার বন্দরের সাথে সংযুক্ত– অস্ট্রিয়া, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, স্লোভেনিয়া, পোল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া-হার্জোগোভিনা এবং সার্বিয়ার কন্টেইনার পরিষেবা।
স্লোভেনিয়ান প্রতিনিধি দল জানায়, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কোপার বন্দরে পণ্য পাঠানো হলে সহজেই ইউরোপের এসব অন্যান্য দেশেও পণ্য পাঠানো সম্ভব হবে।
এই রুটে সরাসরি শিপিং ইউরোপে জাহাজ চলাচলের সময় ১৫-২০ দিন কমিয়ে দেবে।
বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি- বিজিএমইএ নেতারা বলেন, এই শিপিং রুট ব্যবহার করে ইউরোপে বাংলাদেশের পোশাকের বাজার ৫৫ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশে উন্নীত করা যেতে পারে।
এদিকে আসছে নভেম্বরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বন্দরগুলির সাথেও জাহাজ চলাচল শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি রকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, পোশাক রপ্তানিকারকরাই ইউরোপে সরাসরি শিপিংয়ের সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাচ্ছেন। চালান পাঠানোর সময় নিশ্চিত করতে পারায় বায়ারদের পণ্য ডেলিভারি দেওয়া নিয়ে শঙ্কা অনেকটাই দূর হয়েছে। এটি যেন অব্যাহত থাকে তা নিশ্চিত করতে রপ্তানিকারক, শিপিং কোম্পানি এবং ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার-সহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক শামসুল আজম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সরাসরি রুট চালু হওয়ায় ইউরোপে পোশাক রপ্তানিকারকরা অনেক উপকৃত হয়েছে। 'পণ্য আগের তুলনায় অর্ধেক সময়ে এবং কম জাহাজ ভাড়ায় আসছে। ইউরোপে পোশাক রপ্তানিকারকদের জন্য এটা খুবই ইতিবাচক'।
তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকদের একটি বড় অংশের বাজার, কিন্তু এই রুটে এখনো সরাসরি কোনো জাহাজ চলাচল শুরু হয়নি।
শামসুল আজম পরামর্শ দেন, মেইন লাইন অপারেটর এবং শিপিং কোম্পানিগুলো চট্টগ্রাম থেকে চীন হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন রুট খোলার সম্ভাব্যতা যাচাই করতে পারে।
এদিকে, সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড নভেম্বরে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বন্দরগুলিতে একটি নতুন রুট চালু করছে। এই রুটে তিনটি জাহাজ চলাচল করবে।
এই বিষয়ে, গত ২৫ সেপ্টেম্বর এডি পোর্ট গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাফিন ফিডার এবং দুবাইতে নিবন্ধিত সাইফ মেরিটাইম এলএলসি-এর মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
দুবাই থেকে চট্টগ্রামে পণ্য আনতে বর্তমানে ৪৫ দিন সময় লাগে, যা রুটটি সচল হলে ১৮ দিনে নেমে আসবে। সময় বাঁচানোর পাশাপাশি, প্রতিটি ২০-ফুটি কন্টেইনারের খরচ ১৫০ থেকে ২০০ ডলার পর্যন্ত কমে যাবে।
সম্ভাবনার বন্দর
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে আরো বেশি দক্ষ অপারেটর যুক্ত করার পাশাপাশি এবং সক্ষমতা বাড়াতে বিনিয়োগ করলে করে চট্টগ্রাম বন্দর হবে দক্ষিণ এশিয়ার 'বিজনেস হাব'।
গভীরতা কম থাকায় বর্তমানে ৯ দশমিক ৫ মিটারের বেশি গভীরতার জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে আসতে পারে না। ফলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ফিডার ভেসেলে করে কনটেইনার ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর– শ্রীলঙ্কার কলম্বো, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং, তানজুম পেলিপাস বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেখান থেকে মাদার ভেসেলে করে ইউরোপের রটারড্যাম, অ্যান্টওয়ার্প ও হামবুর্গের মতো মূল বন্দরে (বেজ পোর্ট) হয়ে পণ্য পৌঁছে গন্তব্যে। এতে সময় লাগে প্রায় ৪০ দিন।
একইভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি পণ্য প্রথমে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে খালাস করা হয়। এরপর ফিডার ভেসেল বা অপেক্ষাকৃত ছোট জাহাজে করে চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে আসা হয়।
এখন যেসব জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইউরোপ, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বন্দরে পণ্য পরিবহন করছে– সেগুলোর গভীরতা ৯ দশমিক ৫ মিটারের নিচে। শিপিং অপারেটররা আগে এ ধরনের জাহাজ পরিচালনা না করলেও, এখন তারা এবিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
সাইফ মেরিটাইমের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) আবদুল্লাহ জহির টিবিএসকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোতে বিভিন্ন শিপিং লাইনের প্রায় ৬৪টি ফিডার ভেসেল চালাচল করে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ টিবিএসকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইউরোপ, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বন্দরে সরাসরি জাহাজ চালুর সুফল পাচ্ছে ব্যবসায়ীরা। ক্রেতার কাছে কম সময়ে পণ্য পৌছাতে পারছে রপ্তানিকারকরা। এতে অনিশ্চয়তাও কমেছে।
তিনি আরো বলেন, বিভিন্ন সময় ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে দীর্ঘ জটের সৃষ্টি হয়। বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে সরবরাহ চেইন। তখন সঠিক সময়ে পণ্য ডেলিভারি নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়। নতুন নতুন রুট চালু হওয়ায় এখন এসব অনিশ্চয়তা কেটে যাচ্ছে। তবে মেইন লাইন অপারেটরদের (এমএলও) আরো নতুন রুট চালুর উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
শিপিং শিল্পের কর্মকর্তাদের মতে, বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি পণ্যের ৪০% চট্টগ্রাম থেকে কলম্বো বন্দরে পরিবহন করা হয়। বাকি ৬০% সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং এবং তানজুং পেলেপাস হয়ে যায়।
বিজিএমইএ'র তথ্যমতে, ইউরোপে মোট রপ্তানির ৫১%, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২৫%, এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ২০% এবং কানাডায় ৪% করে পোশাক খাত।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ৯২% এবং কনটেইনার চালানের ৯৮% পরিচালিত হয়।
দেশের মোট রপ্তানি পণ্যের ৮২ শতাংশই হলো পোশাক পণ্য।
এক নবযাত্রা:
বেসরকারি অপারেটর ও বন্দর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে- একসময় কনটেইনার বা জাহাজ জটে জর্জরিত চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম বর্তমানে অনেকটাই মসৃণ হয়েছে ।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ বন্দরে আসা একেকটি জাহাজকে গড়ে ৩.৪৫ দিন বহির্নোঙ্গর ও বার্থে থাকতে হয়েছে।
বহির্নোঙ্গরে অপেক্ষার এই সময় এখন কমেছে; পৌঁছানো মাত্রই বার্থ করা বা জেটিতে ভেড়ার সুযোগ পাচ্ছে ৬০-৬৫% জাহাজ। গত ছয় মাসে বাকি জাহাজগুলি এক দিনের মধ্যেই এ সুযোগ পেয়েছে।
বন্দর কতৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, 'এখন পৌঁছানো মাত্র বার্থিং সুবিধা পাচ্ছে ৬০-৬৫ শতাংশ জাহাজ, গত ছয় মাসে বাকিগুলিও ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ভেড়ার সুযোগ পেয়েছে'।
গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমে; ২০২১ সালে বন্দরটি ৩২ মিলিয়ন টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডেল করেছে।
আগের ক্রেনগুলোর পাশাপাশি– নতুন করে যুক্ত হওয়া চারটি কোয়ে গ্যান্ট্রি ক্রেন- এবং আরও কিছু যন্ত্রপাতি যুক্ত হয়ে কনটেইনার পরিচালনার ক্ষেত্রে বন্দরের দক্ষতা বেড়েছে। এতে কমেছে জাহাজের অপেক্ষা ও বার্থিংয়ের সময়।
বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের মে থেকে কনটেইনার হ্যান্ডলিং এর জন্য বন্দরে যুক্ত হয়েছে ১৬টি মেশিন। এরমধ্যে রয়েছে চারটি কোয়ে গ্যান্ট্রি ক্রেন, ছয়টি রাবার টায়ারড গ্যান্ট্রি ক্রেন, ১০০ টন সক্ষমতার দুটি মোবাইল ক্রেন, ৫০ টন সক্ষমতার আরও দুটি মোবাইল ক্রেন এবং দুটি কনটেইনার মুভার।
এই বছরের ডিসেম্বরে আসবে আরও ১৯টি সরঞ্জাম।