এখনও নিরাপত্তা কোডগুলোর পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি চট্টগ্রাম বন্দর
ইন্টারন্যাশনাল শিপ অ্যান্ড পোর্ট ফ্যাসিলিটি সিকিউরিটি তথা আইএসপিএস কোড বাস্তবায়নে ইউএস কোস্টগার্ডের দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ড থেকে ডেলিভারি কার্যক্রম সরিয়ে নেওয়ার কথা ছিলো। চট্টগ্রাম বন্দরের সকল গেটে কন্টেইনার স্ক্যানার স্থাপন, বন্দর এলাকায় সিসিটিভির আওতা বাড়ানো, সন্দেহভাজন গাড়ি দৈবচয়ন ভিত্তিতে যাচাই এবং রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণের আগে স্ক্যানিং করার শর্তও দিয়েছিলো ইউএস কোস্ট গার্ড।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ইউএস কোস্ট গার্ডের প্রতিনিধি দল চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শনে এসে এসব নির্দেশনাসহ ১৬টি পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলো। গত পাঁচ বছরে বন্দর কিছু শর্ত পূরণ করতে পারলেও বন্দর ইয়ার্ডে অবাধ যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ, ডেলিভারি কার্যক্রম না সরানো, নিরাপত্তা কার্যক্রম সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের পুরোপুরি সচেতন না করা এবং রপ্তানি পণ্য স্ক্যানিংয়ের আওতায় আনতে পারেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বন্দরের ভেতর ডেলিভারি হওয়ায় প্রতিদিন প্রায় ৭ থেকে ৮ হাজার গাড়ি প্রবেশ করে। এসব গাড়ির চালকের সহকারী সহ পণ্য খালাসে নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের বন্দরে প্রবেশ করতে হয়। যেটিকে বন্দরের নিরাপত্তা ঝুঁকি হিসেবে দেখছে ইউএস কোস্ট গার্ড প্রতিনিধি দল।
শুধু তাই নয়, দ্য ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ডেঞ্জারাস গুডস (আইএমডিজি) কোড বাস্তবায়নে বাংলাদেশ স্বাক্ষরকারী দেশ হলেও এই কোড কোন সংস্থা বাস্তবায়ন করবে তার কোন নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখনো পর্যন্ত ঠিক হয়নি। গত ৪ জুন বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর আইএমডিজি ও আইএসপিএস কোড বাস্তবায়নের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।
এর মধ্যে গত ২১ ও ২২ জুন চট্টগ্রাম বন্দরের সার্বিক নিরাপত্তা কার্যক্রম সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন ইউএস কোস্ট গার্ডের দুইজন প্রতিনিধি। যদিও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, এই পরিদর্শন বিএম কন্টেইনার ডিপোর ঘটনায় নয়, তাদের নিয়মিত পরিদর্শনের অংশ।
সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের আড়ালে যেন কোন অপরাধ কর্মকাণ্ড সংঘটিত না হয়, সেজন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শক্রমে আন্তর্জাতিক মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও) আইএসপিএস কোড বাস্তবায়ন করছে।
২০০৪ সাল থেকে, সারা বিশ্বের বন্দরগুলোর নিরাপত্তার জন্য আইএসপিএস কোড বাধ্যতামূলক করেছে আইএমও। চট্টগ্রাম বন্দরও এই কোড মেনে চলছে।
আইএসপিএস কোড বাস্তবায়নে ডেজিগনেটেড অথরিটির (ডিএ) প্রধান হচ্ছেন নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ডিজি (মহাপরিচালক)। এই অথরিটিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বন্দরের প্রতিনিধিও রয়েছে। এই অথরিটি বন্দরে আইএসপিএস কোডের শর্তগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা সেটি মনিটরিং করে।
এদিকে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ক্যাপ্টেন এ.কে.এম শফিকুল্লাহ টিবিএসকে বলেন, 'বাংলাদেশ আইএমডিজি কোড বাস্তবায়নকারী একটি দেশ। এই কোড বাংলাদেশে বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা এটা দেখার জন্য বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোন অথরিটি গঠন করা হয়নি। একটি ইন্টারন্যাশনাল অডিটে বলা হয়েছে আইএমডিজি কোড বাস্তবায়নে নির্দিষ্ট অথরিটি গঠন করতে হবে। তিনবছর ধরে এই প্রক্রিয়া চললেও এখনো পর্যন্ত সেটি গঠন হয়নি।'
এ.কে.এম শফিকুল্লাহ আরো বলেন, আইসিডিগুলো পরিচালনার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করে চট্টগ্রাম বন্দর। নীতিমালা অনুযায়ী সেগুলো পরিচালিত হচ্ছে কিনা সেগুলো দেখে চট্টগ্রাম বন্দর। আইসিডিগুলো যেহেতু বন্ডেড ওয়্যারহাউস, সে ক্ষেত্রে বন্ডেড ওয়্যারহাউসের লাইসেন্স দেয় কাস্টমস।
২০০৪ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এ.কে.এম শফিকুল্লাহ বলেন, 'মূলত আমার দায়িত্ব পালনকালীন সময় অর্থাৎ ২০০৪ সাল থেকে আইএসপিএস কোড বাস্তবায়ন শুরু করে চট্টগ্রাম বন্দর। মার্কিন প্রতিনিধি দলের পরিদর্শনে বন্দরের গেটে স্ক্যানার বসানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। এছাড়া আইসিডিতেও স্ক্যানার বসানোর সুপারিশ ছিলো তাদের। আমি তিন মাস আগে আইএসপিএস কোড এর একটি অডিটের কাজে চট্টগ্রাম বন্দরে গিয়েছিলাম। সেখানে মনে হয়েছে বন্দর এরিয়ায় নিয়মিত টহলের জন্য পর্যাপ্ত পেট্রোল ভ্যানের অভাব রয়েছে। প্রতিটি সিকিউরিটি পয়েন্টে পেট্রোল ভ্যান ঘণ্টায় অন্তত ১ বার টহল দেওয়া উচিত। কিন্তু বন্দরে তিন থেকে চার ঘন্টায় একবার টহল দিচ্ছে। এছাড়া বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, অগ্নিনির্বাপন সহ সকল বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের আরো প্রশিক্ষিত করা উচিত।'
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান টিবিএসকে বলেন, 'ইউএস কোস্টগার্ডের প্রতিনিধি দল দুই দিনের পরিদর্শনের বিষয়ে তাদের নিদের্শনা পরবর্তীতে জানাবে। রপ্তানি পণ্যের স্ক্যানার ক্রয়ের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এলসিএল কার্গো ডেলিভারি জেটির পাশ থেকে সরানো হয়েছে।'
সব পণ্যের ডেলিভারি চট্টগ্রাম বন্দর সংরক্ষিত এলাকা থেকে সরানোর বিষয়ে তিনি বলেন, 'আমাদের বন্দরের মডেল বিশ্বের অন্য মডেল থেকে ভিন্ন।'
বিজিএমইএ সূত্র জানায়, বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮২ শতাংশ পোশাক পণ্য। এর মধ্যে ২৫ শতাংশের বাজার আমেরিকা। যেসব দেশ থেকে আমেরিকা পণ্য আমদানি করে সেসব বন্দরে আইএসপিএস কোড বাস্তবায়ন করা হচ্ছে আমেরিকার আগ্রহে। সুতরাং ইউএস কোস্ট গার্ডের প্রতিনিধি দলের প্রস্তাবনাগুলো চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত।
নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের নটিক্যাল সার্ভেয়ার (মেরিটাইম সেইফটি) কমান্ডার এম শাকেরের সাথে যোগাযোগ করা হলে ইউএস কোস্ট গার্ড প্রতিনিধি দলের বৈঠক নিয়ে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।