এআইয়ের সঙ্গে লড়াইয়ে মানুষ টিকে থাকতে পারবে কি না জানি না: ইউভাল নোয়া হারারি
মানবজাতির ইতিহাস নিয়ে ইউভাল নোয়াহ হারারি-র লেখা বই 'সেপিয়েন্স' পেয়েছে তুমুল জনপ্রিয়তা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) উত্থান নিয়ে চিন্তিত এই ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক। সম্প্রতি দ্য টেলিগ্রাফ-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এআই নিয়ে তার চিন্তা ও দর্শন।
দ্য টেলিগ্রাফকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এআই প্রসঙ্গে ৪৭ বছর বয়সি হারারি বলেন, 'ইতিহাসে এটাই প্রথম প্রযুক্তি যা গল্প তৈরি করতে পারে।' তার দৃষ্টিতে, 'গল্পের' ওপর আমাদের সামষ্টিক বিশ্বাস—ধর্মে, অর্থনীতিতে ও অপর জাতির প্রতি—পৃথিবীতে মানবজাতির আধিপত্য জোরদার করেছে।
এখন এআইও এমন গল্প বুনতে পারে। এআই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, প্রযুক্তির ভালো ও ক্ষতিকর উভয় দিকই আছে। একসময় যাকে বহুদূরের ও তাত্ত্বিক জিনিস মনে হতো, আজ তা বাস্তব, হাতছোঁয়া দূরত্বের। এ কারণেই গত মাসে চ্যাটজিপিটির মতো সফটওয়্যার নিয়ে গবেষণা স্থগিতের আহ্বান জানিয়ে কয়েক হাজার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি যে চিঠি দেন, তাতে শামিল হয়েছিলেন হারারিও। উল্লেখ্য, চ্যাটজিপিটি সৃজনশীল লেখা তৈরিতে সক্ষম।
অন্যান্য এআই প্রযুক্তি ছবি ও শব্দেও এমন সৃজনশীল ক্ষমতা দেখাতে পারে। হারারি বলেন, 'নতুন প্রজন্মের এআই শুধু মানুষের তৈরি কনটেন্টই ছড়াচ্ছে না, নিজেও কনটেন্ট তৈরি করছে। কল্পনা করুন তো এমন এক পৃথিবীর কথা, যেখানে সিংহভাগ লেখা, গান, টিভি সিরিজ, ছবির স্রষ্টা হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। কেমন লাগবে সেই পৃথিবীতে থাকতে? এই ব্যাপারটির অর্থ আমরা বুঝতে পারছি না। সংস্কৃতি যদি এআইয়ের দখলে চলে যায়, এর পরিণতি কী হবে?'
এমন ছোটখাটো নজির ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। গত সপ্তাহেই এক জার্মান ম্যাগাজিন এআইয়ের সাহায্য নিয়ে মাইকেল শুমাখারের একটি ভুয়া সাক্ষাৎকার ছাপে। হারারি বলেন, এআই অচিরেই এরচেয়েও বড় কেরামতি দেখাবে। যেমন, অনলাইনে আপনি কোনো রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে কারও সঙ্গে তর্ক করলেন। দুজন মানুষ কথা বলছে এমন একটি ভিডিও-ও পাঠানো হলো আপনাকে। কিন্তু দেখা গেল ভিডিওতে যারা কথা বলছে সে কোনো রক্ত-মাংসের মানুষ নয়, তাদের বানিয়েছে এআই।
অদূর ভবিষ্যতে দেখা যাবে এআই স্রেফ মানুষের ছবি বা ভিডিও তৈরিতেই আটকে নেই। সে আমাদের প্রিয় বন্ধু বা আত্মীয়ের ভিডিও বানাচ্ছে। কারণ ঘনিষ্ঠ মানুষজন আমাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। দেখা যাবে, তাদের মতো চেহারার মানুষের ভিডিও বানিয়ে এআই জলবায়ু পরিবর্তন, টিকা বা অভিবাসীদের ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর চেষ্টা করছে।
হারারি বলেন, এআই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কেলেঙ্কারিগুলোকে—যেমন ব্রাজিল থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে কেমন ভূমিকা রেখেছে—আগামী ১০ বছরের মধ্যে একেবারেই মামুলি ব্যাপার করে তুলবে। জিচিএইচকিউ-এর প্রধান জেরেমি ফ্লেমিং মন্ত্রিসভাকে সতর্ক করে দিয়েছেন, এআইয়ের ছড়ানো ভুল তথ্য মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে।
হারারি বলেন, 'এটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলোর চেয়ে বিশেষ করে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জন্য বেশি বিপজ্জনক। কারণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো প্রকাশ্য বক্তব্যের ওপর নির্ভরশীল। গণতন্ত্র মূলত আলোচনা। মানুষের পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা। এই আলোচনার দখলই যদি এআইয়ের হাতে চলে যায়, গণতন্ত্রের জীবনাবসান হবে।'
তবে যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো সর্বগ্রাসী রাষ্ট্র প্রযুক্তিকে বিদ্বেষের বশে ছেড়ে দিলে তার প্রভাব কেমন হবে? এই যেমন, গুগলের এইআই সিস্টেম কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়া নিজে থেকেই বাংলা শিখে নিয়েছে।
হারারি বলেন, 'নাৎসি রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল ট্রেন, বিদ্যুৎ ও রেডিওর মতো প্রযুক্তিগুলোর ওপর ভিত্তি করে। ওদের কাছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো কোনো অস্ত্র ছিল না। একুশ শতকে একটি নতুন রাষ্ট্রের কাছে এরচেয়ে অনেক অনেক শক্তিশালী অস্ত্র থাকবে। কাজেই এর পরিণতিও অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক হতে পারে। মানবসমাজ এর সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে পারবে কি না, আমি জানি না।'
তিনি বলেন, 'আরেকটি বিপদ হলো বহু লোক সম্পূর্ণ কর্মহীন হয়ে পড়তে পারে। স্রেফ সাময়িকভাবে নয়, মৌলিক দক্ষতার অভাবে ভবিষ্যতের চাকরির বাজারে তারা কর্মহীন হয়ে পড়তে পারে। আমরা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারি যেখানে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা লাখ লাখ মানুষকে একেবারেই অপ্রয়োজনীয় হিসেবে দেখবে। এর নেতিবাচক মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক প্রভাব হবে ভয়াবহ।'
এআইকে আলাদা করেছে এ ব্যক্তিস্বাধীনতা। এটি নিজে নিজে চিন্তা করতে পারে। এর গভীর প্রভাব নিয়েও উদ্বিগ্ন হারারি।
তিনি বলেন: 'আমাদের বুঝতে হবে যে ইতিহাসে এআই-ই প্রথম প্রযুক্তি যা নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারে। নিজের ব্যবহার কীভাবে হবে সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে এটি। আপনার-আমার ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নিতে পারে সে। এটা কোনো ভবিষ্যৎ পৃথিবীর পূর্বাভাস নয়। এটাই হচ্ছে এখন।'
হারারি এমন কিছু বিখ্যাত ঘটনার উল্লেখ করেন যেখানে ঋণের জন্য আবেদনকারীর ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা আছে কি না অথবা কয়েদিকে মুক্তি দেওয়া উচিত কি না, তা নির্ধারণে এআই সফটওয়্যারের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। 'তো, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ক্ষমতা সরে যাচ্ছে। আমরা এমন একটা জিনিস আবিষ্কার করেছি যা আমাদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে। আর ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটছে যে সিংহভাগ মানুষই বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে এআই যেন আমাদের জীবনের ব্যাপারে ভালো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ সমস্যার সমাধান থেকে আমরা এখনও বহু দূরে আছি।'
হারারি এখন এআইয়ের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের সমর্থনে কথা বলছেন। তিনি বলেন, 'একটি ওষুধ কোম্পানি দীর্ঘ নিয়ন্ত্রণমূলক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে না গিয়ে গিয়ে নতুন কোনো ওষুধ বাজারে আনতে পারে না। করপোরেশনগুলো যেভাবে চাইলেই, কোনো নিরাপত্তা পদক্ষেপ ছাড়াই, অত্যন্ত শক্তিশালী এআই টুল বাজারে ছাড়তে পারে সেটা সত্যিই অদ্ভুত এবং ভীতিজনক।'
এআইয়ের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এমন নিয়মনীতি প্রণয়নের জন্য সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন হারারি। প্রযুক্তি শিল্প নিজে থেকে এমন নিয়মনীতি প্রণয়ন করবে, এমন আশা করাটা বোকামি। 'ইলন মাস্ক, জাকারবার্গ ও অন্যান্য বড় প্রযুক্তি কোম্পানির প্রধানদের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই বলছি, তারা কেউই নির্বাচিত প্রধান নন, নিজেদের শেয়ারহোল্ডার ছাড়া আর কারও প্রতিনিধিত্ব করেন না তারা। কাজেই তাদের বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।' হারারির এ দাবি প্রমাণ করার জন্যই যেন চ্যাটবট নিয়ে গবেষণা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে চিঠি দেয়ার কদিন পরই মাস্ক ঘোষণা দিয়েছেন যে তিনি নিজেই এআই চ্যাটবট আনবেন।
হারারি তার নিজের ফোন অধিকাংশ সময় বন্ধ করে 'ড্রয়ারে' রেখে দেন। একে তিনি 'ইমারজেন্সি স্মার্টফোন' নাম দিয়েছেন। তিনি বলেন, 'স্মার্টফোন ছাড়া কোনো কাজ করা সত্যিকার অর্থেই অসম্ভব হয়ে পড়েছে।'
স্মার্টফোন থেকে প্রতিনিয়ত 'বাজে তথ্যের' স্রোত মগজে ঢুকতে থাকে বলে মনে করেন হারারি। 'ফালতু তথ্যে চারপাশ সয়লাব। এটা অনেকটা খাবারের মতো। মানব ইতিহাসের সিংহভাগ সময়জুড়ে আমরা মরিয়া হয়ে বেশি বেশি খাবারের খোঁজে ঘুরে বেড়িয়েছি। আর এখন আমরা দাঁড়িয়ে আছি বিপরীত পরিস্থিতে। যেসব খাবার আমার খাই সেগুলোর পরিমাণ ও গুণগত মান, দুটোর বিষয়েই আমাদের অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে।'
[ইউভাল নোয়া হারারি প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক। তার বিখ্যাত বই 'সেপিয়েন্স: আ ব্রিফ হিস্ট্রি অভ হিউম্যানকাইন্ড' ও 'হোমো ডিউস'। হারারির জন্ম ও বেড়ে ওঠা ইসরায়েলের হাইফায়। পড়াশোনা হিব্রু ইউনিভার্সিটি অভ জেরুজালেম-এ। তার বেস্টসেলার বই 'সেপিয়েন্স'-এর পাণ্ডুলিপি ইসরায়েলে উপর্যুপরি প্রত্যাখ্যানের শিকার হয়। শেষতক বইটির প্রকাশক পেলেও, সেটির ইংরেজি অনুবাদ বাধ্য হয়ে তিনি নিজেই করেন এবং অ্যামাজনের প্রিন্ট-অন-ডিমান্ড সেবার মাধ্যমে ছাপেন। 'সেপিয়েন্স' বিশ্বজুড়ে ২৩ মিলিয়ন কপির বেশি বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে হারারি হিব্রু ইউনিভার্সিটি অভ জেরুজালেম-এর লেকচারার।]