বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেনে অনিয়মের জন্য ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা
বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেনে অনিয়ম রোধে নতুন করে অর্থদণ্ড আইন করতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যার মাধ্যমে সর্বনিম্ন ৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সাধারণত দেশের ব্যাংকগুলোর অনুমোদিত ডিলার শাখা ও মানি চেঞ্জারগুলোর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেনের কার্যক্রম হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বৈদেশিক লেনদেনে অনিয়ম ও আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচার ধরণের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে নতুন অর্থদণ্ড আইন করতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলমান নীতিমালায়, কোন ব্যাংকের এডি লাইসেন্স শাখা ও মানি চেঞ্জারগুলো ফরেন কারেন্সি লেনদেন ও আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে অনিয়ম করলে সর্বোচ্চ লাইসেন্স বাতিল ও আদালতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মামলা করতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, "ফরেন কারেন্সি লেনদেন ও আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং করে থাকে। একটি প্রতিষ্ঠানের এডি শাখার মাধ্যমে হাজার প্রতিষ্ঠানের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম হয়ে থাকে। একটি অনিয়মের কারণে লাইসেন্স বাতিল করলে অন্যান্য কার্যক্রম ব্যাহত হবে, তাই লাইসেন্স বাতিলের আইন থাকলেও এমন পদক্ষেপ খুবই কম নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব অনিয়মে কোন অর্থদণ্ড না থাকায় কিছু প্রতিষ্ঠান ইচ্ছে করেও আমদানি-রপ্তানিতে অনিয়ম করতো। এসব রোধে প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থদণ্ড শাস্তি দেয়ার জন্য নতুন আইন করা হচ্ছে।"
তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি এসব অনুমোদিত ডিলার ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে পণ্য আমদানিতে অনিয়ম ও রপ্তানি পণ্যের মূল্য যথানিয়মে প্রত্যাবাসন হচ্ছে না। যার ফলে আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের আড়ালে দেশ থেকে বিদেশে অর্থপাচারের ঝুঁকি বেড়েছে। যার সঙ্গে অনেক সময় দেখা যায় সরাসরি ব্যাংকগুলো জড়িত। তাই এসব অনিয়ম রোধে আর্থিক জরিমানার আওতায় আনতে নতুন এ ধারা যুক্ত করতে যাচ্ছে।
গত মঙ্গলবার (২২ নভেম্বর) ফরেন কারেন্সি লেনদেনে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিক জরিমানার আওতায় আনতে একটি বিধি প্রণয়ন করতে অর্থ মান্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
চিঠিতে বলা হয়, অনুমোদিত ডিলার ও মানি চেঞ্জারগুলোকে নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলার আওতায় আনার জন্য দি ফরেন একচেঞ্জ রেগুলেশন এ্যাক্ট ১৯৪৭ এর ৩(৫) ধারাটি ২০১৫ সালে সংশোধন করার মাধ্যমে ধারাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে একই আইনের ২৭ ধারার অধীনে সরকার কর্তৃক কোনো বিধি প্রণয়ন করা হয়নি অর্থাৎ অনিয়ম হলে কী শাস্তি তা স্পষ্ট নেই। যার কারণে অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।
তাই এর পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় বৈদেশিক মুদ্রাবাজার এবং দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের কার্যক্রম সুশৃঙ্খল পরিবেশ আনয়নে এবং যথাযথ বাজার অবকাঠামো নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণে সরকার কর্তৃক দি ফরেন একচেঞ্জ রেগুলেশন এ্যাক্ট ১৯৪৭ এর ৩(৫) ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে একই আইনের ২৭ ধারার আওতায় একটি বিধিমালা প্রণয়ন করতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, "ব্যাংক এক্সচেঞ্জ হাউজ ও মানিচেঞ্জারগুলো ফরেন কারেন্সি লেনদেনে অনিয়মে জড়িয়ে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনিটরিং করে প্রমাণ পেলেও আইনের দুর্বলতায় যথার্থ ব্যবস্থা নিতে পারে না। যদি প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়মের বিপরীতে যথার্থ দণ্ড না থাকে তাহলে যতই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নির্দেশনা দেক তারা (প্রতিষ্ঠানগুলো) তোয়াক্কা করবে না। তাই এই অর্থদণ্ডের আইনটা ভালো হবে।"
সূত্রমতে, বাংলাদেশ ব্যাংক হতে অনুমোদিত ডিলার যদি অনুমোদনের শর্তাবলি লঙ্ঘন, জারিকৃত সব আদেশ বা নির্দেশ লঙ্ঘন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শককে অসহযোগিতা, কোনো মিথ্যা তথ্য দেয়া এবং নথিপত্র ইচ্ছকৃতভাবে নষ্ট বা ভুলভাবে উপস্থান করা হয়, তাহলে এ বিধিমালা জারির আওতায় ব্যাংক ও মানিচেঞ্জারকে বৈদেশিক লেনদেনে নূন্যতম ৫ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হবে। আর এ অনিয়ম যদি অব্যাহত থাকে তাহলে প্রথম দিনের পর থেকেই প্রতিদিনের জন্য ১ হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়। এ জরিমানার অর্থ ১৪ দিনের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। আর তা দিতে ব্যর্থ হলে নোটিশ ছাড়াই তাদের একউন্ট থেকে জরিমানার অর্থ আদায় করে নেয়া হবে।
দেশের রিজার্ভের পরিমাণ কমতে থাকায় ব্যাংকগুলোতে তরল ডলার সংকট তৈরি হয় গত এপ্রিল থেকে। প্রবাসীদের আসা কমতে থাকায় দেশে ক্যাশ ডলারের সাপ্লাই কম থাকায় গত ১২ জুলাই প্রথমবারের মতো খোলাবাজারে ডলার দাম বিক্রি হয় ১০০ টাকায়।
এরপরে ক্রমান্বয়ে দাম বাড়লে-কমলেও ১০ আগস্ট ডলারের দাম বেড়ে যায় ১২০ টাকায়। এরপর ডলারের কারসাজি রোধে খোলাবাজার ও এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোতে অভিযানে নামে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মানি চেঞ্জারগুলোর এমন কর্মকাণ্ডে সর্বমোট ৪৯টি প্রতিষ্ঠানকে ডলার কেনাবেচায় বিভিন্ন অনিয়মের কারণে শোকজ করা হয়। আর ৫টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে।
গত এপ্রিল থেকে ডলারে সংকট শুরু হয়। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধীরে ধীরে দাম বাড়ায় ও রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে শুরু করে। এরপরও বাজার স্বাভাবিক না হওয়ায় গত জুলাইয়ে ব্যাংকগুলো পরিদর্শন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ডলার কেনাবেচায় অতি মুনাফা করার তথ্য পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এর পরিপ্রেক্ষিতে অতি মুনাফার জন্য গত ৮ আগস্ট দেশি-বিদেশি ছয় ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। যদিও পরবর্তীতে তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।