বিশ্বের দীর্ঘতম ফ্লাইট যেভাবে টানা দুই মাসেরও বেশি সময় আকাশে থাকার রেকর্ড গড়েছিল!
গত বছরের আগস্টের শেষের দিকে 'জেফর' নামের একটি সৌরচালিত ড্রোন বিমানচালনার ইতিহাসে দীর্ঘতম ফ্লাইটের রেকর্ড ভাঙার খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর নির্মিত ও পরিচালিত এই মনুষ্যবিহীন এয়ারক্রাফটটি একটানা ৬৪ দিন ১৮ ঘণ্টা ২৬ মিনিট আকাশে উড়েছিল। কিন্তু বিরল এক রেকর্ডের অধিকারী হওয়ার মাত্র চার ঘণ্টা আগে অ্যারিজোনায় এই এয়ারক্রাফটটি বিধ্বস্ত হয়।
বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম ফ্লাইটের রেকর্ডটি হয়েছিল আজ থেকে ৬৪ বছর আগে। ১৯৫৯ সালে রবার্ট টিম এবং জন কুক নামের দুই আরোহী চার আসনবিশিষ্ট একটি বিমানে করে লাস ভেগাসের আকাশে উড়ে বেড়িয়েছিলেন টানা ৬৪ দিন ২২ ঘণ্টা ১৯ মিনিট! এরপরে বছরের পর বছর ধরে প্রযুক্তি অগ্রসর হয়েছে, অবিশ্বাস্য গতি-ক্ষমতাসম্পন্ন অনেক বিমান তৈরি হয়েছে; কিন্তু টিম ও কুকের সেই রেকর্ড কেউই ভাঙতে পারেনি। এমনকি স্বয়ংক্রিয়ভাবে উড়তে থাকা ড্রোন 'জেফর'ও শুধু যে ব্যর্থ হয়েছে তা নয়, এটিতে ছিল না কোনো যাত্রীও। তাই 'জেফর' যদি রেকর্ডটিকে ছাড়িয়েও যেত, তবুও টিম-কুকই এগিয়ে থাকতেন।
আর এটাও কম অবাক হওয়ার বিষয় নয় যে টিম এবং কুক এমন এক যুগে তাদের রেকর্ড গড়েছিলেন যা বর্তমানের চাইতে বরং রাইট ভাতৃদ্বয়ের সময়কালের কাছাকাছি যায়!
জ্বালানি সমস্যা
টানা দুই মাস বিমানে করে আকাশে থাকার কথা শুনলে প্রথমেই যে প্রশ্ন আসে তা হলো- জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে কী করতেন?
১৯৫৬ সালে লাস ভেগাস স্ট্রিপের দক্ষিণ প্রান্তে চালু হয়েছিল হেসিয়েন্ডা হোটেল অ্যান্ড ক্যাসিনো। লাস ভেগাসের একেবারে শুরুর দিকের পরিবারভিত্তিক রিসোর্টগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল এই হেসিয়েন্ডা হোটেল। যেহেতু নতুন চালু হয়েছিল, তাই হোটেলের মালিক এটির প্রচারণা চালাতে চাইছিলেন। এসময় হোটেলের এক কর্মী পরামর্শ দেয়, একটা বিমানের গায়ে হোটেলের নাম লিখে সেই বিমানটিকে দিয়ে বিশ্বের দীর্ঘতম ফ্লাইটের রেকর্ড গড়তে। উল্লেখ্য যে, এর আগের রেকর্ডটি ছিল ১৯৪৯ সালে, ৪৭ দিনের ফ্লাইটের।
মালিককে এই পরামর্শ দেওয়া কর্মীটি ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একজন প্রাক্তন ফাইটার পাইলট। পরবর্তীতে তিনি হেসিয়েন্ডা হোটেলে স্লট মেশিন মেরামতকারীর কাজ নেন। আর তিনিই আমাদের গল্পের নায়ক রবার্ট টিম। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তাকে ১০০,০০০ ডলার দেওয়া হয়েছিল যা পরে ক্যান্সার গবেষণার জন্য একটি তহবিল সংগ্রহকারীর সাথে যুক্ত করা হয়।
টিম নিজের পছন্দসই একটি 'সেসনা ১৭২' বিমান বেছে নিয়ে সেটিকে মডিফাই করার পেছনে কয়েক মাস সময় ব্যয় করেন। ডেটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাভিয়েশন ইতিহাসবিদ ও অধ্যাপক জ্যানেট বেডনারেক বলেন, "এটা ছিল একেবারেই নতুন ধরনের একটা ডিজাইন। চার আসনের সেই বিমানটি তুলনামূলক সহজে উড্ডয়নযোগ্য বলে বিবেচিত হতো- এটা ছিল এমন একটা বিমান যার দিকে বারবার নজর দিতে হয় না। আর যখন আপনি দীর্ঘ সময়ের ফ্লাইটে থাকেন, তখন আপনি এমন একটা বিমান চাইবেন যা খুব সুন্দরভাবে চলবে, পথে কোনো বিপত্তি ঘটাবে না।"
কিন্তু 'সেসনা ১৭২' বিমানে আসলে কী কী পরিবর্তন এনেছিলেন টিম? তিনি এই বিমানে রেখেছিলেন ঘুমানোর জন্য একটি ম্যাট্রেস এবং একটা ছোট স্টিলের সিংক; সেই সাথে ভেতরের ইন্টেরিয়র থেকে অনেক জিনিস সরিয়ে ফেলেছিলেন বিমানটিকে হালকা রাখার জন্য, এবং রুডিমেন্টারি অটোপাইলট।
তবে অধ্যাপক জ্যানেটের মতে, 'সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল কীভাবে জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে পুনরায় জ্বালানি নেওয়া যায়। এ বিষয়টি নিয়েই সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন টিম; কিন্তু 'সেসনা ১৭২' বিমানকে মাঝ আকাশে রিফুয়েল (পুনরায় জ্বালানি নেওয়া) করার কোনো উপায় ছিল না। তাই তারা একটা বাড়তি ট্যাংক যোগ করেন যেটি নিচে রাখা একটি ট্রাক থেকে জ্বালানি নিতে পারবে। যখন তাদের রিফুয়েল করার দরকার পড়েছে, বিমানটি অনেকটা নিচে নেমে এসেছে এবং আকাশে থাকা অবস্থায়ই ট্রাক থেকে একটি পাইপ সংযোগ দেওয়া হয়েছে এবং পাম্পের মাধ্যমে বিমানে জ্বালানি সরবরাহ করা হয়েছে। টিম ও কুক তাদের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সত্যিই একটি চমৎকার এয়ারম্যানশিপের প্রমাণ দিয়েছিলেন। কারণ পুরো ফ্লাইটে কখনো কখনো রাতেও তাদেরকে এই জ্বালানি নেওয়ার কাজটি করতে হয়েছে এবং নির্ভুলতার সাথে বিমান চালাতে হয়েছে।"
চতুর্থবারে সফল
বিশ্বের দীর্ঘতম ফ্লাইটের রেকর্ড গড়তে টিম কুকের প্রথম তিনবারের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় বিভিন্ন যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে। প্রথম তিনবারের চেষ্টায় তিনি এবং তার কো-পাইলট সর্বোচ্চ ১৭ দিন আকাশে থাকতে পেরেছিলেন। ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বরে সেই রেকর্ড ভাঙে অন্য একটি টিম এবং তারাও একটি 'সেসনা ১৭২' বিমানে ছিল। পরবর্তী দলটি টানা ৫০ দিন আকাশে অবস্থান করে।
তবে তিনবার ব্যর্থ হয়েও হাল ছাড়েননি টিম। এবারে তিনি কো-পাইলট হিসেবে জন কুককে নির্বাচন করেন এবং কুকও ছিলেন একজন এয়ারপ্লেন মেকানিক।
১৯৫৮ সালের ৪ ডিসেম্বর লাস ভেগাসের ম্যাকক্যারেন বিমানবন্দর থেকে নিজেদের ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু করেন রবার্ট টিম এবং জন কুক। এর আগে যতবার তারা উড্ডয়ন করেছিলেন তাতে প্রথম পদক্ষেপ ছিল একটা স্পিডিং কারের ওপর দিয়ে খুব নিচুতে উড়ে চলা এবং ল্যান্ডিং হুইলের (চাকা) যেকোনো একটিতে রং করে রাখা। এতে করে তারা যদি ল্যান্ড করে ফেলেন তাহলে মাটির সাথে চাকার ঘষা লেগে রঙ হালকা হয়ে যাবে এবং কেউ প্রতারণা করলে তা ধরা যাবে।
চতুর্থবারের ফ্লাইটে শুরুতে বেশ ভালোভাবেই চলছিল তাদের বিমান এবং বড়দিনও তারা পালন করেছিলেন আকাশেই। প্রতিবার যখনই তারা রিফুয়েল করেছেন—তারা হেসিয়েন্ডা রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার-পানীয়ও নিয়ে নিয়েছেন। অন্যদিকে, বাথরুম করার জন্য ফোল্ডেবল ক্যাম্প টয়লেট স্থাপন করেছিলেন তারা এবং বর্জ্যগুলো পরে মরুভূমির ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় ফেলে দেওয়া হয়েছিল। কো-পাইলটের জায়গার পাশে কিছুটা বাড়তি জায়গায় গোসল এবং শেভ করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল।
৬৪ দিনের ফ্লাইটে টিম এবং কুক দুজনে রাতে পালা করে ঘুমিয়েছেন; একজন যখন সজাগ ছিলেন তখন অন্যজন বিমান নিয়ন্ত্রণ করেছেন; যদিও ইঞ্জিনের শব্দ এবং এরোডায়নামিক ভাইব্রেশনের মধ্যে শান্তিতে ঘুমানো অসম্ভব ছিল। এদিকে পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে ৩৬তম দিনের মাথায় টিম বিমান চালাতে চালাতেই ঘুমিয়ে পড়েন এবং বিমানটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রায় ৪০০০ ফুট ওপর দিয়ে নিজে নিজেই এক ঘণ্টা উড়তে থাকে! যদিও কয়েকদিনের মধ্যেই তা আর কাজ করতো না।
অবশেষে বিজয়
ভ্রমণের ৩৯তম দিনে বিমানে জ্বালানি নেওয়ার বৈদ্যুতিক পাম্পটি কাজ করা বন্ধ করে দেয় এবং এর ফলে বিমানটিকে ম্যানুয়ালি চালাতে হয়। ১৯৫৯ সালের ২৩ জানুয়ারি যখন তারা আগের দলের রেকর্ডটি পেছনে ফেলেন, তখন দেখা গেল বিমানের আরও অনেক সমস্যার মধ্যে কেবিন হিটার, জ্বালানি পরিমাপ করা এবং ল্যান্ডিং লাইটে সমস্যা ছিল।
"কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হলো বিমানের ইঞ্জিনটি একবারও কাজ করা বন্ধ করেনি যা প্রায় অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার ছিল। কারণ দুই মাসেরও বেশি সময় চলেছিল এই ফ্লাইট। জ্বালানি ও তেল সরবরাহ করা হলেও, বিমানে উৎপন্ন হওয়া তাপ ও ঘর্ষণ থেকে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারতো", বলেন অধ্যাপক জ্যানেট।
কিন্তু সব বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও রবার্ট টিম ও জন কুক যেকোনো উপায়ে তাদের বিমানটি যতদিন সম্ভব আকাশে রাখতে সফল হয়েছিলেন, যাতে করে তারা এমন একটি রেকর্ড গড়তে পারেন যা সহজে কেউ ভাঙতে পারবে না। তাই আরও ১৫ দিন তারা চালিয়ে যান।
অবশেষে দুই মাসেরও বেশি সময় টানা ১৫০,০০০ মাইল পথ পাড়ি দেওয়ার পর ১৯৫৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি রবার্ট টিম ও জন কুক ম্যাকক্যারেন বিমানবন্দরে অবতরণ করেন।
অধ্যাপক জ্যানেট বেডনারেক বলেন, "আমার মনে হয় তারা একেবারে শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিলেন এবং যখন দেখলেন- আর বেশিক্ষণ আকাশে থাকলে বিমান দুর্ঘটনায় পতিত হতে পারে- আর সেটা অবশ্যই কোনো ভালো কাজ হবে না; তখন তারা অবতরণের সিদ্ধান্ত নেন। তাছাড়া এই দীর্ঘদিনের নিষ্ক্রিয়তা শরীরের পক্ষেও অনেক ক্ষতিকর। কারণ বিমানের ভেতরে তারা নড়াচড়া করলেও, ঠিকমতো উঠে দাঁড়াতে বা হাঁটাচলা-ব্যায়াম করতে পারতেন না। এই ৬৪ দিন অনেকটা বসেই কাটিয়েছেন তারা দুজন।"
কিন্তু এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, টিম ও কুকের বিশ্বের দীর্ঘতম ফ্লাইটের রেকর্ড কি আদৌ কেউ ভাঙতে পারবেন? অধ্যাপক জ্যানেট মনে করেন, বিমান চালনার ক্ষেত্রে নতুন কোনো শক্তির উৎস ব্যবহার নিয়ে পরীক্ষা চালানো হলে তা সম্ভব।
তবে কেউ এই রেকর্ড ভাঙার চেষ্টা করার আগে কো-পাইলট জন কুকের একটি সতর্কবাণী মনে রাখা উচিত। সেসময় তাদের অবিশ্বাস্য রেকর্ড গড়ার পরপর এক সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেছিলেন যে- সুযোগ পেলে আবারও এরকম দীর্ঘ সময়ের ফ্লাইটে যাবেন কিনা? জবাবে কুক বলেছিলেন, "এরপরে আবার এমন ফ্লাইটে ওঠার ইচ্ছা হলে আমি বরং নিজেকে ময়লা ফেলার বক্সে বন্দী করে রাখব, সাথে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার চলবে এবং টিমকে বলবো থার্মোস বোতলে করে আমাকে টি-বোন স্টেক খাওয়াতে। সেটাও আবার আমার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ পরদিন তার চেম্বার খোলার আগপর্যন্ত।"
সূত্র: সিএনএন